Advertisement
Advertisement

Breaking News

জঙ্গলগড়ের ইতিকথা

'আগুন চাপা পড়েছে মাত্র। এখনও নেভেনি।'

The story of Jungle Mahal
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:November 28, 2018 10:47 am
  • Updated:November 28, 2018 10:47 am

কিংশুক প্রামাণিক: এই সেই বুড়িশোলের জঙ্গল। সাত বছর আগে এইখানেই পড়েছিল কিষানজির লাশ। যৌথবাহিনীর বুলেটে ক্ষতবিক্ষত। কিষানজির সময়কাল ছিল সংক্ষিপ্ত। কিন্তু নিঃসন্দেহে একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয় সেদিন। কিষানজির মৃত্যু বড় খবর হয়েছিল দেশজুড়ে।

সোমবার দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক সেই জায়গায়। লাল কাঁকুরে মাটির উপর শাল-পিয়ালের জঙ্গল এখানে আরও যেন ঘন। সবুজ মিশে গিয়েছে অন্ধকারে। ওদিকে গেলেই ঝাড়খণ্ড সীমান্ত। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় ওই রাজ্যে। পালানো অথবা আত্মগোপনের পক্ষে জায়গাটি ভালই ছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মরতেই হল তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে শেষ জঙ্গলমহল মাওপর্বের। ‘শেষ’ শব্দটায় কারও কারও আপত্তি। তাঁরা বলেন, আগুন চাপা পড়েছে মাত্র। এখনও নেভেনি।

Advertisement

[তবে কি অবলুপ্তির পথে আন্দামানের প্রাচীন সেন্টিনেলিজরা?]

Advertisement

সে যাই হোক, বাস্তব হল, তারপর থেকে আর বারুদের গন্ধ নেই জঙ্গলের বাতাসে। নেই লাশের মিছিল। স্কুল খুলল, বাজার বসল, বাস চলল পথে। মানুষ গেল কাজে। সাত বছর পরও সেই শান্তি বিরাজমান। রাতদিন এখন সমান জঙ্গলমহলে। মাইন পোঁতা পথ ধরে এখন দেখা যায় শ’য়ে শ’য়ে সাইকেল চলেছে। ‘সবুজ সাথী’রা তাতে সওয়ারি। এই অধ্যায় বলে দেয় পরিবর্তন এসেছে। মানুষ শান্তিতে আছে।

কিষানজির মৃত্যুতে সেদিন আবার প্রমাণ হয়েছিল, বন্দুকের নল কখনও মানবতার মুখ হতে পারে না। হত্যা হতে পারে না সমাজের হিতসাধনের পথ। কাউকে মেরে কোনও কিছুর সমাধান হয় না। তা সে যতই মহৎ কাজই হোক না কেন! আর সব যুদ্ধ ‘কুরুক্ষেত্র’ নয়। হত্যা অপরাধ। একদিন প্রত্যাঘাত আসে। সেই পরিণতি হয় ভয়ংকর। তাই চারু মজুমদার থেকে কিষানজি ওরফে কোটেশ্বর রাও, অনন্য আরও এক মেধার বেঘোরে মৃত্যু। যিনি সত্যি একজন সফল দেশনায়ক হতে পারতেন– অভাগা জাতিকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারতেন– হতে পারতেন একজন বিজ্ঞানী, গবেষকও– যিনি নোবেল পুরস্কার এনে জাতিকে হয়তো সমৃদ্ধ করতেন।

সেইসময় বাঙালির ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়েছিলেন সিপিআই-মাওবাদীর এই তাত্ত্বিক জঙ্গি নেতা। কাঁধে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে ক্যামেরার দিকে পিছন ফিরে বাংলায় প্রেস কনফারেন্স করতেন। যখন তখন টেলিভিশন চ্যানেলে ‘ফোনো’ দিতেন। আমার সঙ্গে তাঁর দেখা বা কথা কখনও হয়নি। কিন্তু অনেক সহকর্মী সাংবাদিকদের মুখে শুনেছি, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ তুখড় ছিল কিষানজির। আত্মরক্ষার জন্যই ঘন ঘন মোবাইল নম্বর বদলাতেন। মধ্যরাতে তাঁর ফোন আসত। ঠান্ডা গলায় বলতেন, ‘খবর আছে ভাই।’ কিষানজি কথা বলতেন গুছিয়ে। মানুষও খুব কৌতূহলের সঙ্গে তাঁর কথা টিভিতে ‘গিলত’। আসলে ‘অরণ্যদেব’ থেকে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’– বাঙালি বরাবর বীরপুজোয় বিশ্বাস করে এসেছে। রহস্য, রোমহর্ষক কাহিনিতে বড় আগ্রহ তাদের। তাই জঙ্গলমহলের রক্তাক্ত অধ্যায়ের খলনায়ক হলেও এই যে পরদার আড়াল থেকে তিনি কথা বলতেন, সেটা খুব কৌতূহল তৈরি করেছিল। ফলে অনেকের মধ্যে কিষানজি সম্পর্কে একটা সম্ভ্রমও সেই সময় লক্ষ করা যেত। এমনই ছিল সেই মিথ যে ছোট্ট শিশুকে ঘুম পাড়াতে কোনও মা হয়তো ভয় দেখিয়ে বলতেন, ‘বেটা সো যা, নেহি তো কিষানজির আ যায়েগা।’

সেই কথাগুলোই আবার মনে পড়ছে এবার জঙ্গলমহলে এসে। মুখ্যমন্ত্রীর সফর চলছে। ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় তিনি ঘুরছেন। প্রশাসনিক বৈঠক, প্রশাসনিক পরিষেবা প্রদান। লক্ষ্য নির্দিষ্ট। মানুষ কী চাইছেন? বৈঠকে কাজ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। জামবনি কাপগাড়ি কলেজ মাঠে কোনও মুখ্যমন্ত্রী তো দূরের কথা, নেতা-মন্ত্রীরা আসতে ভরসা পান না। একপাশে ঝাড়খণ্ড, অন্যপাশে ওই কুখ্যাত বুড়িশোল। কিন্তু মমতা সেখানেই সভা করলেন। বিশাল সমাবেশ হল তঁার কথা শুনতে।

শুনলাম, মাওবাদীরা এখনও ভালভাবেই আছে। তবে এপারে নয়, ওপারে ঝাড়খণ্ডে। জঙ্গলমহলে ঢোকার নানা চেষ্টা করছে। কিন্তু হালে পানি পাচ্ছে না। পোস্টার পড়েছে, কিন্তু সেটা আদৌ তাদের কি না পুলিশ সন্দিহান। সত্যি কথা বলতে কী, এদিকে আসার ভরসা পাচ্ছে না বন্দুকধারীরা। এর মূল কারণ কী? যদি বলা হয়, বাহিনীর সক্রিয়তা, তাহলে পুরোটা বলা হবে না। আসলে এদিকের গ্রামগুলিতে আর আগের মতো আশ্রয় পাচ্ছে না মাওবাদীরা। বাম আমলে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে জঙ্গলমহলে সিপিএমের কমরেডরা বেপরোয়া হয়ে উঠছিলেন। জোরজুলুম, চাঁদা আদায়, সালিশি, জব কার্ড-রেশন কার্ড-ভোটার কার্ড পার্টি অফিসে জমা করে নেওয়ার জেরে মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল বিদ্রোহের আগুন। তারা সুযোগ খুঁজছিল। খুব স্বাভাবিকভাবে এই সময় কিষানজিরা জায়গা করে নেন গ্রামের পর গ্রামে। মানুষ মনে করে, সিপিএমের হাত থেকে মাওবাদীরা মুক্ত করবে। গ্রামের ছেলেরাই তাই প্রশিক্ষণ নিয়ে রাইফেল হাতে তুলে জঙ্গলে চলে যায়। শুরু হয় রক্তাক্ত যুদ্ধ। সিপিএমের রাজ্য নেতারা যখন বুঝলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পালটা বন্দুকবাজ বাহিনী তৈরি করলেন তঁারা। সেটাই তাঁদের হল বুমেরাং।

[‘সীমাবদ্ধ ছুটি’র ফাঁদে ইতিহাস সংকুচিত]

মমতা বুদ্ধিমতী। তিনি মানুষের মধ্যে থাকেন বলে তাদের পাল্‌স বোঝেন। তাই কমরেডদের রোগ যাতে তাঁর দলে না ঢোকে তার জন্য তিনি গোড়া থেকে সতর্ক। ঝাড়গ্রামের পর পুরুলিয়া, তিনি যেভাবে জনপ্রতিনিধিদের একাংশকে ‘ধোলাই’ দিলেন তাতে স্পষ্ট, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে তিনি বদ্ধপরিকর। কাউকে রেয়াত করবেন না। বুঝিয়ে দিলেন, কোনও ব্যক্তিগত দায় তিনি নেবেন না। জব কার্ড, রেশন কার্ড-সহ কোনও কার্ড কাউকে মানুষ যেন না দেয়। মানুষের জন্য তাঁর সামাজিক প্রকল্প। তার জন্য কাউকে পয়সা দিতে হবে না। বলা বাহুল্য, মানুষ এই ভরসাটাই তাঁর কাছে চায়।

এদিকে পাশেই ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়। বাংলার সীমান্তবর্তী জঙ্গলের লোকসভা আসনগুলি কেন্দ্রের শাসক দলের টার্গেট। ফলে পাশের রাজ্য থেকে লোক এনে বিজেপি সংগঠন তৈরি করতে চাইছে। পঞ্চায়েত ভোটে কিছু জিপিতে তারা সফল। মমতা খুব স্বাভাবিকভাবে এসব বরদাস্ত করছেন না। তাই উন্নয়ন দিয়েই জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের মতো বিজেপির মোকাবিলা করছেন। মানুষকে বলছেন, শান্তি তিনি ফিরিয়েছেন। পাশেও তিনি আছেন। বিজেপি বরং মাওবাদীদের মদত দিয়ে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। জঙ্গলকে আর অশান্ত করতে তিনি দেবেন না।

আসলে এ এক বিরাট রাজনৈতিক যুদ্ধ। লোকসভা ভোট অবধি চলবে। মমতা সেটা জানেন। তাই বুক দিয়ে আগলাচ্ছেন তাঁর জঙ্গলগড়। সিপিএমের মতো ভুল করার বান্দা তিনি নন।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ