Advertisement
Advertisement
লাদাখ

গালওয়ান থেকে পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার মোদির নেতৃত্বের পরবর্তী পরীক্ষা

অতীতের ভুল শুধরে গালওয়ান থেকে শিক্ষা নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে।

Time to learn from Galwan crisis, India have to keep tab on China
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:July 8, 2020 7:33 pm
  • Updated:July 8, 2020 7:33 pm

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত কিছু কিছু সিদ্ধান্ত আচম্বিতে নিতে ভালবাসেন। এটা আমরা ‘নোটবন্দি’-র সময় দেখেছি। মাঝরাতে সংসদের সেন্ট্রাল হল থেকে ‘জিএসটি’ চালু করার সিদ্ধান্তগ্রহণের সময় দেখেছি। জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করা ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের সময় দেখেছি। ‘লকডাউন’ ঘোষণার সময় দেখেছি। এবার দেখলাম, লাদাখ সফরের সময়। রাজনীতির অলিন্দের ফিসফিসানি, এই সিদ্ধান্তগুলির একটাও ঘনিষ্ঠ দু’-চারজন ছাড়া কেউ জানতেন না। নোটবন্দি নিয়ে প্রয়াত অথর্মন্ত্রী অরুণ জেটলি তো কবুলই করেছিলেন, বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানতেন না। তাঁকে কিছু জানানো হয়নি।

[আরও পড়ুন: চিনের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে ভারতের পাশে থাকবে মার্কিন ফৌজ, ইঙ্গিত হোয়াইট হাউসের]

এই অতি গোপনীয়তার ভাল ও মন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। ভাল হল, প্রধানমন্ত্রী যা ঠিক মনে করছেন, গণতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে তা অনায়াসে করে ফেলতে পারেন। মন্দটা, সিদ্ধান্ত বিগড়ে গেলে তার দায় পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীকেই বইতে হবে। কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারবেন না। যে সিদ্ধান্তগুলোর উদাহরণ দিলাম, প্রায় প্রতিটিই প্রবল বিতর্কিত এবং সরকার একটি সমালোচনাও ‘গঠনমূলক’ মনে করেনি। সিদ্ধান্তগুলো ভাল না মন্দ, ঠিক না ভুল, সমালোচনা ন্যায্য কি না- তা নিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অব্যাহত। কোনও কোনও সিদ্ধান্ত এখনও ঝুলে রয়েছে ন্যায়ালয়ের বদান্যতায়। হয়তো কোনও একদিন এগুলোর প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। স্বস্তির কথা, প্রধানমন্ত্রীর লাদাখ সফরের পরপরই উত্তেজনা প্রশমনে চিন ও ভারত সেনা সরাতে সহমত হয়েছে। ভারতকে শুধু নিশ্চিত করতে হবে- চিন (China) যেন স্বভাব অনুযায়ী দু’পা এগিয়ে এক পা পিছনোর নীতিতে অটল না থাকে।

Advertisement

‘সারপ্রাইজ এলিমেন্ট’ বাদ দিলে লাদাখ (Ladakh) সফরের সিদ্ধান্ত ছিল প্রয়োজনীয় ও বিচক্ষণ। লাদাখে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেককে অনেকগুলো বার্তা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীকে বুঝিয়েছেন, সব সহায়তা নিয়ে দেশ রয়েছে তাঁদের পাশে। এমন সফর জওয়ানদের মনোবল বাড়ায়। কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছেন চিন ও দুনিয়াকে। ভারত যে ১৯৬২ সালে থমকে নেই, আগ্রাসনের জবাব দিতে প্রস্তুত, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত সংঘর্ষের পর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় শক্তি বাড়িয়ে বুঝিয়েছেন, পাকিস্তানের মতো চিনকেও বিশ্বাস করা হবে মারাত্মক ভুল। সিয়াচেন ও কারগিলে নজরদারিতে ঢিলেমি দিয়ে ভারত ভুল করেছিল। গালওয়ান কাণ্ডের পর সেই ভুল ভারত দ্বিতীয়বার আর করবে না।

Advertisement

লাদাখে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে ‌‘চিনা সম্প্রসারণবাদ’-এর স্বরূপও বে-নকাব করেছেন। চিন কেমন তা আমেরিকা, জাপান, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার এখন জানা। কোভিডের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশও চিনের উপর বিরক্ত। ভারত কী চায়, সম্পর্কের অর্থ কী, স্পষ্ট করে মোদি সবাইকে তা বুঝিয়েছেন। ভারতীয়দের চিন-বিদ্বেষ বাড়ছে। পণ্য বয়কটের দাবি মান্যতা পাচ্ছে। স্বনির্ভর হওয়ার তাগিদ বাড়ছে। কিন্তু সেজন্য যথেষ্ট সময় ও ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন। কেননা, চিনকে ভাতে মারার ক্ষমতা আকণ্ঠ চিন-নির্ভর ভারতীয় অর্থনীতির একার কম্ম নয়। তাদের মোট রপ্তানি-কৃত পণ্যের মাত্র তিন শতাংশ ভারতে আসে। এই কাজটা করতে গেলে ভারতকে জোটবদ্ধ হতে হবে। গালওয়ান কাণ্ড সেই সুযোগ ভারতের কাছে হাজির করেছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার মোদির নেতৃত্বের পরবর্তী পরীক্ষা। আপাতত লাদাখ সফর সেই দিশায় ঠিক পদক্ষেপ।

প্রধানমন্ত্রীকে ইদানীং অবশ্য কিছু কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ঠাসবুনট দল, নেতৃত্বের ভাবমূর্তি, প্রবল ব্যক্তিত্ব, ছত্রখান বিরোধী শিবির, প্রশ্নাতীত আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য এবং বিপুল সংসদীয় গরিষ্ঠতা ও অর্থবল এই পরীক্ষাগুলো উতরোতে সাহায্য করছে। কিন্তু তাই বলে প্রশ্ন কি উঠবে না? গণতন্ত্রে প্রশ্ন উঠবেই। উঠছেও। সর্বশেষ যে প্রশ্ন গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি করেছে তা গালওয়ান কাণ্ড ঘিরেই। ছ’-বছরে প্রথম ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুধু বিস্ময় উদ্রেককারীই ছিল না, চিনের কাছে তা ছিল না-চাইতেই বৃষ্টিতুল্য। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দূরদর্শনে সম্প্রচারিত। নির্যাস জলের মতো স্বচ্ছ। বিভ্রান্তিও অবকাশহীন। পরের দিন সেই বক্তব্যের সরকারি ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেয় আগের দিন কী মারাত্মক ভুলটাই না তিনি করেছিলেন! মোদির বক্তব্য ততক্ষণে চিনের হাতিয়ার। বক্তব্যকে ঢাল করে বলতে থাকে নিজেদের গণ্ডিতেই তারা আবদ্ধ। বিরোধীদের দাবি ও চাপ অগ্রাহ্য করতে আচমকা লাদাখ যাওয়া ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তাই উপায় ছিল না। সেইদিক থেকে আচম্বিত ওই সফর ছিল জরুরি ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু সেখানেও তাঁকে ডোবায় অত্যুৎসাহী সঙ্গীরা!

লাদাখ সফরের যাবতীয় তথ্য মিডিয়াকে জুগিয়েছেন সরকারি কর্তারাই। কিন্তু নির্দেশ ছিল, খবর করতে হবে ‘সরকারি সূত্র’-র বরাতে। সেই সূত্র অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী একটা ‌‘ফরওয়ার্ড বেস’-এ গিয়েছিলেন। ‌‘নিমো’। স্পষ্টতই, কর্তাদের জানা ছিল না, নিমো লাদাখের একটা নামী পর্যটন কেন্দ্র। রিভার রাফটিংয়ের জন্য বিখ্যাত। ভৌগোলিক অবস্থান লেহ্-র ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে। অথচ গালওয়ান উপত্যকা লেহ থেকে ২১৫ কিলোমিটার উত্তর-পুবে। সড়কপথে সময় লাগে সাতঘণ্টা। এটুকুও তাঁদের জানা ছিল না, ফরওয়ার্ড ঘাঁটিগুলো বাছা হয় সীমান্ত থেকে বড়জোর ২০-২৫ কিলোমিটার দূরের সুবিধাজনক অবস্থানে। যেমন, কারগিল রণাঙ্গনের ফরওয়ার্ড বেসগুলো ছিল দ্রাস, মাতাইন, বাটালিক, কাকসারে, যেখান থেকে একটা-দুটো পাহাড় টপকালেই ছিল পাকিস্তানি ঘাঁটি! সিয়াচিনের ফরওয়ার্ড বেস হিমবাহের শেষে, যেখান থেকে নুবরা উপত্যকার শুরু।

অত্যুৎসাহীরা প্রধানমন্ত্রীকে ডুবিয়েছেন হাসপাতাল সফরেও। লেহ সামরিক হাসপাতালের যে-অংশের ছবি ও ভিডিও সম্প্রচারিত, তা হাসপাতাল বলে ভাবা সত্যিই কঠিন। চিকিৎসাধীন কোনও জওয়ানের শরীরে দৃশ্যত আঘাতের কোনও চিহ্ন ছিল না! টানটান করা বিছানায় তাঁরা বসে আছেন যেন প্রাণায়াম করতে করতে প্রধানমন্ত্রীকে দেখে চোখ খুলে ফেলেছেন! সবাই একভাবে, এক ঢংয়ে, একই ভঙ্গিতে বসে! কারও বিছানার পাশে ওষুধ বা জল রাখার টুল নেই। একটাও অক্সিজেন সিলিন্ডার কিংবা ‘পেশেন্ট মনিটর’ নেই। হাসপাতালে রোগীর বিছানায় দৈনন্দিন শারীরিক অবস্থার চার্ট লটকানো থাকে। একটাও দেখা গেল না। কোনও ফ্রেমে একজনও ডাক্তার বা নার্সের উপস্থিতি নেই। হাসপাতালে ঢুকলে যা যা চোখে পড়ার কথা কোনওটাই দৃশ্যমান নয়। এই নিয়ে হুলস্থুল হওয়ার পরের দিন সেনাবাহিনীর বিবৃতি ও ব্যাখ্যাও বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে ব্যর্থ! নেতাদের বোঝা প্রয়োজন, এমন অত্যুৎসাহিতা লিমিটেড ওভার ক্রিকেটের স্লগ ওভারে পর পর ফুলটস ডেলিভারির সমতুল্য! আরও বোঝা দরকার, প্রশ্নকারীদের সেনা বা দেশবিরোধী তকমায় মুড়ে দেওয়াটা কাজের কাজ না।
করোনা রাতের ঘুম কাড়া শুরু করার সময় ১৫ মে, প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়েছিল বিল গেটসের সঙ্গে। সেই বিল গেটস, যিনি ২০১৫ সালেই বলেছিলেন, ‘আগামিদিনের যুদ্ধ ভাইরাসের বিরুদ্ধে।’ প্রধানমন্ত্রীকে সেদিন তিনি বলেন, ‘সিইও হিসাবে মনে হয় সমালোচনা ও খারাপ খবরগুলো শোনা সবচেয়ে জরুরি। নইলে কাছের মানুষজন ধীরে ধীরে আর তা কানে তুলবে না। শেষের শুরু সেটাই।’ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরসিমা রাও তাঁর আস্থাভাজনদের বলেছিলেন, ‌‘‌‌আমার যা শুনতে ভাল লাগবে তা শোনানোর প্রয়োজন নেই। সত্যটা বলবেন।’ প্রধানমন্ত্রী হয়ে মনমোহন সিং সচিবালয়ের কর্তাদের বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আপনারাই আমার চোখ-কান। অতএব ভাল-মন্দ
নির্ভয়ে বলবেন।’ সমালোচনা শুধু মিডিয়া ও বিরোধীদের অধিকার নয়। জনতারও। বন্ধ হলে বিপর্যয়। অবজ্ঞা ও উপেক্ষা সর্বনাশী।

[আরও পড়ুন: জিনপিংয়ের জাপান সফরে আপত্তি, প্রধানমন্ত্রী আবের উপর চাপ বাড়াল শাসকদল]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ