Advertisement
Advertisement
Ukraine War

ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারবেন কি পুতিন?

মতাদর্শ পেরিয়ে শক্তির লড়াই।

Will Putin change the course of history? | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 3, 2022 4:40 pm
  • Updated:March 3, 2022 4:40 pm

ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ যদি সত্যিই আবার একটি ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’-র পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে আগের মতোই আবার দেশগুলির মধ্যে শক্তির ভারসাম্যর নয়া সমীকরণ রচনা হবে। তাতে হয়তো মতাদর্শের লড়াই থাকবে না, কিন্তু শক্তির দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার পর মতাদর্শের লড়াই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ফলে এ নিয়ে সংশয় নেই যে, ইতিহাসের গতি আজ নির্ধারিত হচ্ছে শুধুই শক্তির লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। এই শক্তির লড়াইয়ে কোনও ব্যতিক্রমী শক্তিধর নেতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, শক্তিধর নেতারা বরাবরই পেরেছেন ইতিহাসের গতিপথ তৈরি করে দিতে। সিজার থেকে স্তালিন- উদাহরণ এরকম অনেক দেওয়া যায়। ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য কি না, সেই বিতর্ক এখন সামনে চলে এসেছে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: রাশিয়াকে শত্রু করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না ভারতের]

১৯৯০ সালে ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’-র অবসান ঘটেছিল গর্বাচেভ ও বুশের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তার আগে ৪৫ বছরের দীর্ঘ ঠান্ডাযুদ্ধে বিশ্ব চূড়ান্ত অস্ত্র প্রতিযোগিতা, শিবির ভাগাভাগি, অর্থনৈতিক চাপ, সামরিক হস্তক্ষেপ, কূটনীতির মারপ্যাঁচ ইত্যাদি সবই দেখেছিল। শুধু ঘন ঘন বারুদের গন্ধ শুঁকতে হয়নি। ১৯৬২ সালে কিউবা সংকটের সময় দুই মহাশক্তির মুখোমুখি যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ১৯৭১-এ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও আমাদের ঘরের কাছে বঙ্গোপসাগরে মুখোমুখি চলে এসেছিল সোভিয়েত সাবমেরিন ও মার্কিন সপ্তম নৌবহর। দু’ক্ষেত্রেই দুই মহাশক্তিধরের সংঘর্ষ এড়ানো গিয়েছিল। পরমাণু যুদ্ধের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল বিশ্ব। ফলে ঠান্ডাযুদ্ধের অবসানের পর মনে হয়েছিল, এবারও হয়তো মুখ ঘুরিয়ে নেবে মারণাস্ত্র। কিন্তু তা হয়নি। একথা ঠিক যে, ঠান্ডাযুদ্ধের অবসানের পূর্বশর্ত হিসেবে ‘ওয়ারশ চুক্তি’-ভুক্ত দেশগুলির জোটের অবসান হয়েছিল এবং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধে্য দাঁড়িয়ে থাকা বার্লিনের প্রাচীর ভেঙেছিল। কিন্তু ঠান্ডাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও বিশ্বজুড়ে শক্তির লড়াইটা শেষ হয়নি। বরং ঠান্ডাযুদ্ধর অবসানের অব্যবহিত পরেই কুয়েত ও ইরাকের সংঘর্ষ তথা ‘গাল্‌ফ ওয়ার’-এর মধ্য দিয়ে শক্তির নতুন ভারসাম্য নির্মাণের লড়াই শুরু হতে আমরা দেখেছি। ‘গাল্‌ফ ওয়ার’ জেতার পর আমেরিকা ‘একমেরু বিশ্ব’-র নতুন জমানার প্রচার শুরু করে। মার্কিন চিন্তাবিদদের কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘ইতিহাসের পরিসমাপ্তি’ ঘটেছে। পুতিনের সাম্প্রতিক এই উত্থান যেন ঠান্ডাযুদ্ধোত্তর বিশ্বের তিন দশকের এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল।

Advertisement

বেলারুশের সীমান্তে রাশিয়া-ইউক্রেন আলোচনা হয়েছে। যদিও দু’দেশের দীর্ঘদিনের এই সংঘাতের মধে্য সর্বাত্মক একটি যুদ্ধ লেগে যাওয়ার উপাদান এখনও রয়েছে। তাঁকে ময়দানে নামিয়ে একা ফেলে দেওয়ার জন্য ‘ন্যাটো’ অন্তর্ভুক্ত তাঁর বন্ধু দেশগুলির প্রতি যেভাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অভিমান বর্ষণ করে চলেছেন, তাতে বলা যায় না কখন কী ঘটে যায়! কিয়েভের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জেলেনস্কির অসহায় আর্তি নিশ্চয়ই ‘ন্যাটো’ জোটের শক্তিধরদের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। কারণ, এরপরেই কিয়েভ উদ্দেশে রওনা দিয়েছে টন-টন গোলা-বারুদ। এমনকী জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী চুক্তিভঙ্গ করে কিয়েভে মারণাস্ত্র পাঠাতে সম্মত হয়েছে। এই ঘটনাপ্রবাহ যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধের বাঁক ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া, এখনকার বিশ্বে যুদ্ধ মানেই ‘কো-ডেস্ট্রাকশন’। সেটা পুতিনও বোঝেন। ইউক্রেনে কত রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে, সেই হিসাব প্রকাশ্যে আাসেনি। কিন্তু সেটা তো একদিন জানা যাবেই। কিয়েভের রাস্তায় চলমান রুশ শ্মশানের ছবি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ফলে যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে যে পুতিনও আগ্রহী, তা নিয়ে সংশয় থাকা উচিত নয়। কিন্তু এই যুদ্ধ যে, দেশগুলির মধ্যে শক্তির নতুন ভারসাম্যের জন্ম দিতে চলেছে, তা বলেই দেওয়া যায়। শক্তির ভারসাম্যর যে পরিচিত ছকটা ঠান্ডাযুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে গিয়েছিল, সেটাই যেন ফের ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শক্তিধর পুতিন যেন ইতিহাসের সেই গতিপথ নির্ণয় করতে চাইছেন।

বঙ্গোপসাগরে সেদিন যদি আমেরিকার চোখে ধুলো দিয়ে সোভিয়েতের সাবমেরিন হাজির না হত, তাহলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন‌্যভাবে লেখা হত হয়তো। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রসঙ্গে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়ার ভোটাভুটিতে ভারত অংশ না নেওয়ায় মুক্তিযুদ্ধর সেই স্মৃতি ফের ভেসে উঠেছে। কিউবায় আমেরিকার সপ্তম নৌবহর ঠিক যে কায়দায় সোভিয়েত রুখে দিয়েছিল, ঠিক একইভাবে বঙ্গোপসাগরেও তারা সেটা রুখে দেয়। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের সম্পর্ক যে এখনও অটুট, তা হয়তো রাষ্ট্রসংঘর নিরাপত্তা পরিষদে স্পষ্ট হয়েছে। ভারতের সঙ্গে ভোটদানে বিরত থেকেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও চিনও। নিরাপত্তা পরিষদের এই ভোটাভুটি ঠান্ডাযুদ্ধর শিবির ভাগাভাগির স্মৃতিও একইসঙ্গে উসকে দিয়েছে।

ঠান্ডাযুদ্ধোত্তর বিশ্বে উত্তর বনাম দক্ষিণ লড়াই শুরু হয়। এই লড়াইয়ে তৃতীয় দুনিয়া একদিকে এবং উন্নত দুনিয়া আর-একদিকে। সোভিয়েত ব্লকের অনুপস্থিতিতে ভারসাম‌্য যে উত্তরের দিকেই ঝুঁকেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ যদি সত্যিই আবার একটি ঠান্ডাযুদ্ধর পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে আগের মতোই আবার দেশগুলির মধ্যে শক্তির ভারসাম্যর নয়া সমীকরণ রচনা হবে। তাতে হয়তো মতাদর্শের লড়াই থাকবে না, কিন্তু শক্তির দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে। একমেরু বিশ্বর নয়া জমানার যে আখ‌্যান বিশ্বরাজনীতি ধারাবাহিকভাবে শুনে চলেছে, তার হয়তো অবসান হবে। রাষ্ট্রসংঘ যে এই শক্তিদ্বন্দ্বর নতুন ক্ষেত্র হবে, তা বলাই বাহুল‌্য। বেলারুশের বৈঠক যে-পথেই এগোক, তা নিশ্চিত করেই নতুনভাবে শক্তির ভারসাম্যর জন্ম দিতে চলেছে।

এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে এই যুদ্ধে ভারসাম‌্য পুতিনের দিকেই ঝুঁকে। পুতিন হুমকি দিয়েছেন, ষষ্ঠ আর কাউকে তিনি ন‌্যাটো-য় ঢুকতে দেবেন না। তিন বাল্টিক দেশ-সহ পোল‌্যান্ড ও রোমানিয়ার ‘ন‌্যাটো’ অন্তর্ভুক্তি রাশিয়া মানতে বাধ‌্য হয়েছে। ‘ওয়ারশ চুক্তি’-র অবসান হলেও মুক্ত দুনিয়ার নামে ১৬ সদস্যর ন‌্যাটো আজ বাড়তে বাড়তে ৩০ সদস্যর রাজনৈতিক সামরিক জোটে পরিণত হয়েছে। একমেরু বিশ্বে আমেরিকার এই দাদাগিরি যে তিনি সহ‌্য করবেন না, তা বারবার হুমকি দিয়ে ঘোষণা করছেন পুতিন। এখন এটা দেখার যে, শক্তিধর এই নেতা সত্যিই ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারেন কি না। শক্তির ভারসাম্যে বদল বিশ্বের অর্থনৈতিক চেহারারও অনেকটা পরিবর্তন ঘটাবে। ফলে বলা যায়, ইতিহাসের নতুন একটি বাঁকের মুখে আমরা দাঁড়িয়ে।

[আরও পড়ুন: পুতিন মডেলে ইউক্রেন কেন ‘উদয়ন পণ্ডিত’?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ