কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়: কিছুদিন ধরে খুব অস্বস্তির মধ্যে আছি। আমি আমার আশপাশটাকে চিনতে পারছি না। মানুষ জনকেও নয়। সব পালটে পালটে যাচ্ছে। পালটে যাচ্ছে আমার বাংলা। আমার বাংলার ভাষা ও পরিবেশ। ছোটবেলা থেকে আমি রামায়ণ-মহাভারত পড়ছি। ভাবতেই পারি না ‘রাম’ সমাজের সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। ‘অমর চিত্রকথা’র রাম-সীতা যে কারও অস্ত্র কিংবা উষ্মার কারণ হয়ে উঠতে পারে, আমি ভাবতে পারি না। দেবতার নাম যখন অস্ত্র এবং অস্বস্তি হয়ে ওঠে তখন বুঝতে হবে সময় ঠিক নয়। মানুষের সহনশীলতা কমছে এবং পশ্চিমবঙ্গের এই অচেনা মুখ পৃথিবী দেখছে। আমি বিরক্ত।
আমরা বিরক্ত। আমি লজ্জিত। আমরা লজ্জিত। পরিচালকের পরিচয় ছাড়াও আমি একজন শিক্ষক। এবং একজন বাবা। প্রত্যেকটা পরিচয়ই আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি শিক্ষকতা করেছি প্রায় আট বছর। আমার ছাত্রছাত্রীরা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। সামনাসামনি দেখে চিনতেও হয়তো পারব না। কিন্তু যখন সকালে টিভিতে দেখছি জুনিয়র ডাক্তারদের জমায়েত, ভাবছি তারা হয়তো ওই ধর্মঘটে শামিল। হয়তো ওরা আমারই ছাত্র। ওরা ভীত। ওরা সন্ত্রস্ত। ওরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
যত দেখছি তত আমার পিতৃসত্তায় আঘাত লাগছে। আমার মনে হয় এই জুনিয়র ডাক্তারদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। তাই এই বিক্ষোভ। তাই এই অনাস্থা। তাই এই জমায়েত। এতদিনের চাপা ক্ষোভ ওরা উগরে দিচ্ছে। কেন দেবে না বলুন তো? কী করে যারা আসল ‘বহিরাগত’ তারা হাতে হকি স্টিক নিয়ে ঢোকার সাহস পায়? কী ভাবে অ্যালার্ম বাজানোর পরও কেউ আসতে পারে না তাঁদের বাঁচাতে? কী ভাবে দিনের পর দিন কারওর প্রাণ বাঁচানোর সময় ভাবতে হবে আমার প্রাণ থাকবে তো? এই ভয় ভয়ে মানুষের সেবা করা সম্ভব!
[ আরও পড়ুন: মেলবোর্নে চলচ্চিত্র উত্সবের প্রধান অতিথি শাহরুখ, আপ্লুত অভিনেতা ]
শুটিংয়ের সময় কোনও শট নেওয়ার আগে টেনশন করি। বুঝে উঠতে পারি না শটটা এভাবে নেব না ওভাবে? ঠিক সে সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয়ে যায়। এটা তখনই ঠিক হতে পারে যখন আমার মন হালকা থাকবে। চাপমুক্ত থাকবে। ওদের ক্ষেত্রেও তো বিষয়টা একই। চিকিৎসা করার সময় ওরা যেন ভীত না হয়ে ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ঠিক এমনই এক নিরাপত্তার পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকে। আমি বার বার স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি এটা ভেবে যে কী করে এতগুলো লোক হাসপাতালের ভিতর লাঠিসোটা নিয়ে ঢুকে আসতে পারে?
বিগত বছরেও বহুবার এমনটা ঘটেছে! আমি আশা করব এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতিকে যেন না জড়ানো হয়। এটা একেবারেই রাজনৈতিক কোনও ঘটনা নয়। মাথার খুলিতে আঘাত- এটা রাজনৈতিক সমস্যা নয়। মানবিক সমস্যা। পরিবহ মুখোপাধ্যায় তো আমারও ছেলে হতে পারত। আপনারও! তাই নয় কি? যার সন্তান আছে, সে বুঝতে পারবে ক্ষতটা কত গভীর!
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রশাসনের কাছে আমার আবেদন বিভিন্ন সময়ে আপনারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এবারও অন্যথা করবেন না। কিছু দায়িত্ববান মানুষ ডাক্তারদের সঙ্গে গিয়ে সরাসরি কথা বলুন। আপনাদের মাথায় রাখতে হবে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা সুরক্ষিত না হলে একটা রাজ্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
বাড়ি থেকে শুটিং আসার সময় দেখলাম, হাসপাতাল জুড়ে পুলিশ আর ডাক্তার। রোগীরা আরেক দিকে। এই দৃশ্য অনভিপ্রেত। প্রশাসনের কাছে আমার অনুরোধ- এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একমাত্র পথ চিকিৎসা পরিষেবা যাঁরা প্রদান করছেন তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া। বিশ্বাস করুন, এটাই সমাজের নৈতিক কর্তব্য। পরিশেষে বলি সব ডাক্তার বন্ধুদের, আপনাদের ছাড়া অসুস্থ মানুষেরা বড্ড অসহায়। আপনাদের আন্দোলন যেন কেবল প্রতীকী হয়, পরিষেবা বন্ধ করবেন না। সাধারণ মানুষেরই শুধু ক্ষতি হয়ে যাবে। প্রার্থনা করি আপনারা সবাই যেন সুরক্ষিত থাকেন।
[ আরও পড়ুন: পাক সমর্থকদের ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে অন্তর্বাস খুললেন পুনম! ভাইরাল ভিডিও ]