দীর্ঘদিনের সহযোগী নির্মল চক্রবর্তীর ডেবিউ ফিল্ম ‘দত্তা’-য় ‘বিজয়া’র চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। লিখলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
এটা সিনেমার শুটিংয়ের গল্প হলেও আসলে বন্ধুত্বের গল্প বা বলা যায় আন্তরিকতার গল্প। বোলপুরের কামারপাড়ায় শুটিং। পরিচালক নির্মল চক্রবর্তী। ছবির নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দত্তা’ অবলম্বনে এই ছবি। পরিচালক এবং নায়িকার সম্পর্কটা আসলে ঠিক প্রফেশনাল নয়, বরং বন্ধুত্বের। ঋতুপর্ণার সঙ্গে থেকে দীর্ঘদিন জনসংযোগের কাজ করেছেন নির্মল। কুড়ি বছর ধরে পরস্পরকে চেনেন। ঋতুপর্ণার ছবি রিলিজ মানেই আসবে নির্মলদার ফোন। দীর্ঘদিন এই কাজ করেছেন পরম যত্ন নিয়ে। ঋতুর ব্যস্ত শিডিউল সামলে ঠিক সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। সামলেছেন সবদিক।
আর ঋতুপর্ণা? তিনি বন্ধুর বন্ধু। তার দীর্ঘদিনের সহযোগী যখন ছবি করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, তখন তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আগে খুব বেশি ভাবেননি। ঋতুপর্ণা বরাবরই এরকম। আগেও দেখেছি অনেক ছবি করেছেন ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে। তিনি বন্ধুদের মনে রাখেন। যাঁরা একসময় পাশে ছিলেন তাঁর উত্থানের সময় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত কখনও তাঁদের ভোলেন না। অভিনেত্রীর কাছে সম্পর্কের দাম হয়তো একটু বেশি। আর সেদিন সেই বোঝাপড়ার রেশটা সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ছিল।
[ আরও পড়ুন: বিয়ের হ্যাটট্রিক শ্রাবন্তীর, দেখুন নবদম্পতির ছবি ]
জায়গাটা শান্তিনিকেতনের কাছে। লাল মাটি, সাঁওতাল গ্রাম, তবে নির্জন। কামারপাড়া। সেখানে লক্ষ্মীসায়রের কাছেই হল শুটিং। লক্ষ্মীসায়র একটি বিশাল হ্রদ। দিনটা ছিল আংশিক মেঘলা। বৃষ্টির হবে হবে ভাব। সকালের একপ্রস্থ শুটিং শেষ করে কস্টিউম পালটে ছাইরঙের লাল পাড় শাড়ি পরে এলেন শুটিং স্পটে। কপালে লাল টিপ। একটা অদ্ভুত মায়া চোখে। এখানে ঋতু ‘বিজয়া’র চরিত্রে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। সেই লেজেন্ডারি রোলে এবার ঋতু। তিনি এলেন এবং প্রচণ্ড গরমের তোয়াক্কা না করেই ফোটোগ্রাফারদের আবদার মেটালেন। লক্ষ্মীসায়রের পাড়ে পরিত্যক্ত নৌকোর পাশে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছিলেন অক্লান্ত। একটু পরে শুটিংয়ের প্রপ হিসেবে সাদা ছাতা এনে দিলেন সহকারী। সেটা নিয়েও পোজ দিলেন। ছবি তোলার মাঝেমাঝেই খোঁজ নিচ্ছিলেন পরিচালকের। “কখন পরের শট? নির্মলদা ফিরদৌস কোথায়, ওকে আসতে বলো’, বললেন ঋতুপর্ণা।
কাজের সময় তাঁর পেশাদারিত্বের তুলনা নেই। ছবি তুলতে তুলতেই কথা বললেন, “অনেকদিন পর আবার ‘দত্তা’ হচ্ছে। এর আগে সুচিত্রা সেন এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেটা আমার কাছে একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। দেখা যাক আমরা নতুন কী করতে পারি। চেষ্টা করব ভাল করার। আমাদের কাস্টিং ভাল। শান্তিনিকেতনে শুটিং করতে ভালই লাগে। এখানে আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছবির শুটিং করেছি।” তারপর যোগ করলেন, ‘তোমরা সবাই ঠিক করে খাবে কিন্তু। কাজের মধ্যেও তাঁর আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি নেই।’ শটে যাওয়ার আগে কথা হল পরিচালক নির্মল চক্রবর্তীর সঙ্গে। “সিনেমা করব এটা আমার অনেকদিনের ইচ্ছে। প্রায় আট দশ বছর হবে। আর ছবি করলে ঋতু নায়িকা হবে এটা বলাই বাহুল্য। এটা প্রায় অলিখিত কন্ডিশন বলা যায়।”
“দত্তা’ করব এই ভাবনা গত বছরের। প্রথমে অন্য গল্প ভাবছিলাম তারপর মনে হল সাহিত্য নির্ভর গল্প হলে ভাল হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই গল্পটা আমার প্রিয়। তাছাড়া এই বছর ‘দত্তা’ উপন্যাসের একশো বছর। ১৯১৯ সালে এই উপন্যাস লেখা শেষ হয়। আর এটা ২০১৯। যে স্ক্রিপ্ট লিখেছি সেটা উপন্যাসের গল্প বজায় রেখেই। খুব বেশি কিছু বদলাইনি। আমি পুরনো সময়টাকেই ধরতে চাই। বিজয়ার চরিত্রে ঋতু, নরেনের চরিত্রে জয় সেনগুপ্ত, বিলাসের চরিত্রে ফিরদৌস, রাসবিহারীর চরিত্রে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী এবং দেবলীনা কুমার রয়েছেন একটি চরিত্রে। এখানে শুটিংয়ের পর একটা দেড় মাসের গ্যাপ আছে। তারপর আবার কলকাতায় শুটিং হবে। এই বছরেই ছবি রিলিজ করব”, শটে যাওয়ায় আগে বললেন নির্মল চক্রবর্তী।
[ আরও পড়ুন: ‘কোরান-গীতা-বাইবেল পড়েছি, ভেদাভেদ মানি না’, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বার্তা নুসরতের ]
ফিরদৌস এবং বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী এলেন একটু পরে। মাঠের ধারে বাঁশ ঝাড়ের পাশে সরু একফালি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন ঋতুপর্ণা, রাস্তায় দেখা হচ্ছে বিলাস এবং রাসবিহারীর সঙ্গে। এই সিনটাই শুট হল। এর আগে ছোট্ট পরেশ এবং তার মায়ের সঙ্গে একটা সিন ছিল। জয় সেনগুপ্ত এলেন আরও একটু পরে। সিনেমাটোগ্রাফার মৃন্ময় মণ্ডল খুব নির্বিঘ্নে কাজটা সারছিলেন। কথা হল ফিরদৌসের সঙ্গে। জানালেন ঋতুপর্ণার অনুরোধেই এই ছবিতে রাজি হয়েছেন। ‘আরও একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল এই ছবিতে আমার আর ঋতুর সম্পর্কটা একতরফা প্রেমের। এর আগে অন্য সব ছবিতে ওঁর সঙ্গে সরাসরি প্রেম দেখানো হয়েছে। এই প্রথম অন্য ধরনের অব্যক্ত প্রেম’, হাসতে হাসতে বললেন অভিনেতা।
জয় সেনগুপ্তর সঙ্গে শুটের আগেই হল লাঞ্চ ব্রেক। তখন রোদ পড়ে এসেছে। সাদা শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার পরে এলেন জয়। ঋতুপর্ণা তখন শটে। তার ফাঁকে কথা বলে নেওয়া গেল জয়ের সঙ্গে। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তাঁর ছবি ‘কিয়া অ্যান্ড কসমস’। বাংলা ছবি করতে জয় সবসময়ই আগ্রহী। তিনটে জিনিস মিলে গিয়েছে বলেই ‘দত্তা’ করতে রাজি হয়েছেন তিনি। এক সাহিত্য নির্ভর ছবি করতে উৎসাহী তিনি, দ্বিতীয়ত ঋতুপর্ণার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে আর তৃতীয়ত বাংলা ছবি। ‘চতুরঙ্গ’-র পর আবার ঋতুপর্ণার সঙ্গে দেখা যাবে তাঁকে।
এদিন গোটাটাই ছিল আউটডোর শুট। লক্ষীসায়রের আশপাশের জনবসতি ভিড় করে এসেছিল শুটিং দেখতে। তাদের হাজারো প্রশ্ন এবং কৌতূহল। আশা করা যায় ছবি মুক্তি পেলে এই কৌতূহল বজায় থাকবে দর্শকের মধ্যেও।
ছবি: বিদিশা চট্টোপাধ্যায়