নির্মল ধর: বিভূতিভূষণের গল্প মানেই গ্রামবাংলার এক বাস্তব চেহারার প্রতিফলন। যেখানে নিকষ দারিদ্র, অশিক্ষা, কুসংস্কার, সনাতনী গ্রামবাংলার এক চালচিত্র। সেই ‘পথের পাঁচালি’র পরও তেমন কোনও বদল ঘটে না। এখনও ঘটেছে কি? রাজনীতির ঝান্ডা বদল ছাড়া দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ওয়াজেদ আলির সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে।
বিভূতিভূষণের ‘তালনবমী’ গল্পটি নিয়ে ধনঞ্জয় মণ্ডল একটি ছোট দৈর্ঘের ছবি করেছিলেন। এবার করলেন মানস মুকুল পাল। পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি। মূল কাহিনির বিস্তার ঘটল তাঁর চিত্রনাট্যে। গ্রামীণ অবস্থার বিস্তৃত বিবরণ জায়গা পেল ক্যামেরায়। চিরন্তন বাংলার এক জীবন্ত ছবি উঠে এল। বারবার ‘পথের পাঁচালি’র কথাই মনে পড়ছিল এই ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ দেখতে বসে। পাঠ সত্যিই সহজ, কিন্তু বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাজনা বাজে যে! কোথা থেকে যেন গোপাল ও ছোটুর মধ্যে দুর্গা-অপুর প্রচ্ছায়া খেলা করে। ভাই-দিদির বদলে ভাই-দাদা। কম্বিনেশন তো একই। এখানেও অপুর মতোই ছোটু বড় সরল, দাদার উপর নির্ভরশীল। কোনও রাজনীতির ঝান্ডাই দুই ভাইয়ের সম্পর্ককে মলিন করতে পারবে না। পারেওনি।
[জন্মদিনে ‘খিলাড়ি’ স্টাইলেই নতুন ছবির পোস্টার প্রকাশ অক্ষয়ের]
পরিচালক মানস মুকুল মূল গল্পের স্পিরিটকে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রেক্ষাপটের বিস্তার ঘটিয়েছেন। দুই ভাইয়ের সখ্যতা, নিবিড়ত্ব আরও ঘন করেছেন। ওদের মায়ের চরিত্রকে সর্বজায়ার প্রোটোটাইপ করে তুলেছেন। দারিদ্রের থাবার মধ্যে দাঁড়িয়ে অপত্য স্নেহ ভালবাসাকে কখনও তীব্রতায় তিক্ত করেছে, আবার কখনও মমতায় মাখামাখি হয়ে ‘চিরন্তন’ এক চেহারা নিয়েছে। শুধুমাত্র ‘নেমন্তন্ন’ পাওয়ার আশায় জমিদার গিন্নিকে দুই ভাই অতি কষ্টে জোগাড় করা তালগুলো বিনি পয়সায় দিয়ে এল। অথচ ‘নেমন্তন্ন’ও জুটল না! এর চাইতে বড় ট্রাজেডি আর কী হতে পারে! মানস মুকুলের এই ছবি বিভূতিভূষণের কাহিনির শুধু বিস্তৃত চিত্রায়ণই নয়, তিনি চিত্রনাট্যে আজকের সময়টাকেও ধরতে প্রয়াসী। স্বপ্নে বাবার মৃত্যু এবং মায়ের উদভ্রান্ত হয়ে রেললাইনের দিকে ছুটে যাওয়া এবং রেলগাড়ির চলে যাওয়ার শটটি একেবারেই পথের পাঁচালির দুর্গা-অপুর রেলগাড়ি দেখার শটটাকে মনে করিয়ে দেয়। তবে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে।
‘সহজ পাঠের গপ্পো’কে সুন্দর করে সাজিয়েছেন যেমন দুই ক্যামেরাম্যান মৃণ্ময় মণ্ডল ও সুপ্রতিম ঘোষ এবং তাকে আবহ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন চন্দ্রদীপ গোস্বামী। গ্রামবাংলার বৃষ্টিভেজা মাঠ, পুকুর, ভাঙা কুঁড়ে, দিগন্তবিস্তারী প্রান্তর – সম্প্রতি বাংলা ছবিতে এমন জীবন্ত হয়ে দেখা যায়নি। স্মৃতিমেদুরতা শুধু নয়, মনটাকে ভারী করে দেয়। আর আছে দুই শিশুর ‘অভিনয় নয়’-এর অভিনয়। নূর ইসলাম (ছোটু) ও সামিউল আলম (গোপাল) লেখকের কলমটাকেই জীবন্ত করে দিয়েছে। বিশেষ করে নূর। দু’জনেরই হতাশ ও দরিদ্রমাখা চেহারা অবশ্যই পরিচালকের কাছে প্লাস পয়েন্ট। ওদের কাছ থেকে ‘না অভিনয়’টা আদায় করে নিয়েছেন পরিচালক। স্নেহাও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছেন। ওদের মায়ের ভগ্নশীর্ণ চেহারার পাশাপাশি স্নেহার অভিনয়ও বেশ জোরালো। জমিদার গিন্নির ছোট চরিত্রে শকুন্তলা বড়ুয়াও ভাল।
[‘এ আমার ভারতবর্ষ নয়’, গৌরী হত্যায় ক্ষুব্ধ এ আর রহমান]
তবে এই ছবি শেষ পর্যন্ত পরিচালক মানস মুকুল এবং দুই খুদে অভিনেতা নূর ও সামিউলের। বাঙালি দর্শক যদি এই ছবি শেষ পর্যন্ত না দেখেন, ক্ষতি তাঁদেরই। রহস্য, গোয়েন্দা, প্রেমের ছবির জঙ্গলে এই ছবি একটি পুজোর ফুলের মতো পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.