Advertisement
Advertisement

‘বাবুমশাই’ হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিনে স্মৃতিচারণায় প্রভাত রায়

কেন কিশোরকুমারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি ছিল কিংবদন্তি পরিচালকের?

Prabhat Roy remembers legendary film director Hrishikesh Mukherjee
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:August 27, 2018 1:56 pm
  • Updated:August 27, 2018 1:56 pm

সহজ-সরল গল্প, সহজ-সরল ভাবে পর্দায় তুলে ধরতেন। এমন ছবি যা ভোলা যায় না। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিনে লিখছেন তাঁর স্নেহাস্পদ প্রভাত রায়।

[নচিকেতা, রূপঙ্করদের আড্ডা ছিল শ্যামবাজারের এই চায়ের দোকানে]

Advertisement

‘বাবুমশাই’ ডাকটা মনে পড়লেই বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে, তাই না? মনে হয়, কোনও এক মৃতপ্রায় মানুষ, যে ক’দিন পরেই মারা যাবে, সে তার বন্ধুকে বলছে, ‘বাবুমশাই, জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নহি।’ মনে পড়ে যায় হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘আনন্দ’ ছবিতে রাজেশ খান্নার কথা।

Advertisement

জানেন কি এই ‘বাবুমশাই’ কথাটা হৃষীদার মাথায় এসেছিল কী করে? রাজ কাপুর হৃষিদাকে খুব স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। হৃষীদার সঙ্গে দেখা হলেই রাজ কাপুর খুব মিষ্টি করে বলতেন, “এই যে বাবুমশাই, কেমন আছ?” রাজ কাপুরের সেই ‘বাবুমশাই’ ডাকটাই হৃষীদার মনে ‘আনন্দ’-এর গল্পটা সৃষ্টি করেছিল। হৃষীদাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ‘আনন্দ’ করার জন্যে।

‘আনন্দ’-এর চিত্রনাট্য-সংলাপ লেখেন গুলজারজি। হৃষীদা ভেবেছিলেন, ছবিটা রাজ কাপুরকে নিয়ে করবেন। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, সেই ভাবনাটা তার ইচ্ছাধীন হয় না কখনওই। রাজ কাপুর হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই সময়ে। এমনকী বম্বেতে রটে যায়, রাজজি আর বাঁচবেন না। তখন হৃষীদা ভাবেন তিনি রাজজিকে নিয়ে ছবিটা করার পর শেষ দৃশ্যে ‘আনন্দ’-এর মারা যাওয়ার ঘটনাটা যদি সত্যি হয়ে যায়, সেটা খুবই বেদনাদায়ক হবে।

তখন উনি শশী কাপুরকে নিয়ে ছবিটা করার কথা ভাবেন। কিন্তু সময়ের অভাবে শশী কাপুর ছবিটা করতে পারলেন না। এর পর হৃষীদা কিশোরকুমারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ঠিক করেন কিশোরকুমারকে নিয়ে ‘আনন্দ’ করবেন। কিশোরদা হৃষীদাকে বাড়িতে আসতে বলেন, গল্পটা শোনানোর জন্যে।

কয়েক দিন পর হৃষীদা কিশোরদার জুহুর বাড়িতে যান। কিশোরদার বাড়ির দারোয়ান হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়কে চিনত না। সেই সময় কিশোরদার কড়া নির্দেশ ছিল, কোনও অচেনা বাঙালিকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। তার পিছনে অবশ্য একটা কারণ ছিল। তার কিছু দিন আগে কিশোরদা কলকাতার কোনও একটা ক্লাবের অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। তারা ওঁর বেশ কিছু টাকা দেয়নি। তাই নিয়ে অশান্তিও হয়েছিল। তাই ওই নির্দেশ- বাঙালির প্রবেশ নিষিদ্ধ। দারোয়ান হৃষীদার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে উনি বাঙালি। ব্যস, হৃষীদাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। বাড়ির গেট থেকেই ফিরে আসেন হৃষীদা। এবং সেই দিনই ছবির কস্টিং ফাইনাল করেন। রাজেশ খান্না এবং অমিতাভ বচ্চন। এমনকী ‘আনন্দ’ ছবিতে কিশোরদাকে দিয়ে কোনও গানও গাওয়াননি। এর পর অবশ্য কিশোরদার সঙ্গে হৃষিদার ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান হয়। কিন্তু জানি না সেই দারোয়ানের কী হাল হয়েছিল।

‘আনন্দ’ ছবি রাজেশ খান্নার সাফল্যের মুকুটে আর একটা পালক গুঁজে দেয়। অমিতাভ বচ্চনেরও পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়। এবং ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ২০১২ সালে সেই রাজেশ খান্না মাত্র ৬৯ বছর বয়সে মারা গেলেন ‘আনন্দ’ ছবির মতোই, ক্যানসারে।

মুম্বইতে যখন শক্তি সামন্তর সহকারী হিসেবে কাজ করি, তখন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। ভীষণ ভাল লাগত ওঁর ছবিগুলো। ওঁর ছবির মধ্যে না থাকত ক্যামেরার কোনও জাগলারি, না সেট-সেটিংয়ের চমক, না গল্পের মধ্যে কোনও টুইস্ট বা মোচড়। একটা সহজ-সরল গল্প, সহজ-সরল ভাবে পর্দায় তুলে ধরতেন হৃষিদা। মন ছুঁয়ে যেত। তাই তো ভোলা যায় না ‘অনুরাধা’, ‘আশীর্বাদ’, ‘আনন্দ’, ‘গুড্ডি’, ‘বাবুর্চি’, ‘অভিমান’, ‘নমক হারাম’, ‘মিলি’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘খুবসুরত’, ‘গোলমাল’, ‘সত্যকাম’। আর তার জন্যে পুরস্কৃতও হয়েছেন বহুবার। পেয়েছেন দাদা সাহেব ফালকে, পদ্মবিভূষণ, জাতীয় পুরস্কার এবং ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড।

কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমার যোগ্যতা বা প্রতিভা তো আর হৃষিদার মতো ছিল না, তাই হৃষিদা হওয়ার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গিয়েছে।

হৃষীদা জন্মেছিলেন কলকাতায় ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সালে। আর মারা গিয়েছেন মুম্বইয়ে ২৭ আগস্ট, ২০০৬ সালে। মোট ছবি পরিচালনা করেছেন ৪২টা। বম্বের সেই সময়কার প্রায় সব অভিনেতা অভিনেত্রীকে নিয়েই হৃষীদা ছবি করেছেন। দিলীপকুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, সুচিত্রা সেন, নূতন, সাধনা, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জীবকুমার, রাজেশ, অমিতাভ, শর্মিলা, জয়া ভাদুরি তো আছেনই। হৃষীদা নানা ধরনের ছবি করেছেন। তার মধ্যে যেমন সিরিয়াস ছবি আছে তেমনি কমেডি ছবিও আছে। ওঁকে দেখে কখনও মনে হত না, ওঁর মধ্যে এত হাস্যরস লুকিয়ে আছে। শুনেছি অভিনেত্রী রেখা নাকি ওঁকে মাস্টারমশায়ের চোখে দেখতেন। ভয়ও পেতেন। তাই উনি যখন রেখাকে নিয়ে ‘খুবসুরত’-এর মতো কমেডি ছবি করলেন তখন রেখা খুব অবাক হয়েছিলেন। শুধু অভিনয়ই নয়, ‘খুবসুরত’-এ উনি রেখাকে দিয়ে গানও গাইয়েছিলেন। হৃষীদা-রেখার জুটিতে ‘খুবসুরত’, ‘নমকহারাম’, ‘ঝুটি’ সুপারহিট। সম্ভবত ওঁর শেষ ছবি ‘ঝুট বোলে কউয়া কাটে’। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি আমার আদর্শ হৃষীদার শেষ ছবির কাগজে রিভিউ করার সুযোগ পেয়েছিলাম সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্যের জন্যে। এবং সেইটাই প্রথম কোনও ছবির রিভিউ করার হাতেখড়ি।

হৃষীদাকে প্রথম দেখি বা ওঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় পরিচালক অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে ওঁর বাড়িতে গিয়ে। আমি তখন নতুন নতুন মুম্বই গিয়েছি, অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করি। অজয়দা তখন ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় লিখতেন। হৃষীদাকে পুজো সংখ্যা ‘প্রসাদ’ পত্রিকা দিতে হৃষিদার বান্দ্রার বাড়িতে গেছিলেন অজয়দা। আমিও সঙ্গে গেছিলাম।

হৃষীদা বাড়ির লনে দোলনায় বসে তাঁর পোষ্য কুকুরদের কিছু খাওয়াচ্ছিলেন। হ্যাঁ, খুব ভালবাসতেন কুকুর। অজয়দা আমাকে প্রণাম করতে বললেন। করলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, “এ কে?” অজয়দা বললেন, “আমার অ্যাসিসট্যান্ট। কয়েক দিন হল কলকাতা থেকে এসেছে।” হৃষিদা বললেন, “খুব ভাল। মন দিয়ে কাজ শেখো। আর শোনো বাবা, ডিরেক্টর হতে গেলে কিন্তু এডিটিংটা ভাল করে শিখতে হবে।”

তার পর থেকে এডিটিংয়ের কাজটাও শিখতাম মন দিয়ে। কারণ জানতাম, হৃষীদা নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন এডিটর হিসেবেই। বিখ্যাত পরিচালক বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করতেন। ‘দেবদাস’, ‘মধুমতী’– অনেক ছবির সম্পাদনা করেছিলেন। পুরস্কৃতও হয়েছিলেন অনেকবার।

তার পর যখন শক্তি সামন্তর সহকারী হিসেবে আমি কাজ করছি, সেই সময় মাঝে মধ্যেই হৃষীদার শুটিং দেখতে যেতাম। শক্তিদার অফিস ছিল আন্ধেরির নটরাজ স্টুডিওতে। হৃষিদা তাঁর সব ছবিরই প্রায় শুটিং করতেন কাছেই, মোহন স্টুডিওতে।

হৃষীদার শুটিংয়ে গিয়ে একটা জিনিস দেখে অবাক হতাম। উনি দাবা খেলতে খুব ভালবাসতেন। স্টুডিওর শুটিং ফ্লোরে বসে শুটিং করতে করতেও মাঝে মাঝে দাবা খেলতেন। অবাক হতাম। দাবা যথেষ্ট মনঃসংযোগ করে খেলতে হয়।

[কেন বলিউডে থেকেও আলাদা কাজল? উত্তর দিলেন ঋদ্ধি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ