খনার বচন আজও বাঙালির মুখে মুখে। তিনি থাকলে এক্সিট পোল নয়, তাঁর কথাতেই হয়তো নির্ধারিত হত লোকসভা ফলাফল। কিন্তু সেই খনা সত্যি ছিলেন? না পুরোটা কল্পনা? প্রশ্ন শংকরলাল ভট্টাচার্যের৷
নেই কথায় এই সব বচন আমাদের জিভে চড়ে যায় ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।’ না একটু রোমান্টিক মুডে ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে।’ অথবা তেড়েফুঁড়ে প্রতিবাদের সুরে ‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই, কিল দেওয়ার গোঁসাই।’ কিংবা সরল মন্তব্যের ভঙ্গিতে ‘যদি হয় সুজন এক পিড়িতে নয় জন।’ আর কারও গলাবাজি শুনলে তো বলাই দস্তুর ‘চোরের মা-র বড় গলা।’ কিন্তু এই সব ভাবুক কথা আউড়ানোর সময় কে আর আমরা খেয়াল রাখি এরা বহু যুগ আগে একজন সাংঘাতিক বিদূষী মহিলার মগজ থেকে উতরেছে? যাঁরা খেয়াল রাখেন তাঁদের কাছে একটু লাগসই পরিচিতি আছে এসবের: খনার বচন। খনার বচন মানে এক মস্ত ভাবনার আড়ত। যে আড়ত বাঙালির অব্যর্থ কমেন্ট সাপ্লায়ার। কিন্তু এই বচন ভাণ্ডারের পিছনে খনা-টি কে?
[ আরও পড়ুন: জীবনে সুখ সমৃদ্ধি আনতে এভাবেই পালন করুন নববর্ষ]
তাহলে নিন, খেলা জমিয়ে দেওয়ার মতো ধোনির একটা হেলিকপ্টার শট-খনা আমাদের শহর কলকাতার উপকণ্ঠে বারাসতের লাগোয়া দেউলিয়া গ্রামের মানুষ ছিলেন। তখনকার নাম চন্দ্রকেতুগড়। আর ওঁর সময়টা নবম থেকে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের কোনও এক কাল চন্দ্রকেতুগড় নামটা আজও আছে। বছর ষাটেক আগে খননকার্য করে সেখানে খনা-মিহির ঢিবি একটা আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এই মিহির নামটা জুড়ে যেতে প্রধানত লোককথার চরিত্র খনা ইতিহাসেও ঢুকে পড়েন। শুধু কিংবদন্তি ও ইতিহাস নয়, খনার বচনের খনাকে ঘিরে এতকাল ধরে পাক দিয়ে চলছে অজস্র রোমাঞ্চকর গল্পকাহিনি। খনার সঙ্গে যে মিহির নামটা আসে মনে করা হয় সেটা উজ্জ্বয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার নবরত্নের অন্যতম রত্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহিরের পুত্র মিহিরের। বরাহমিহিরের জন্ম (৫০৫ খ্রিঃ) ও মৃত্যুর (৫৮৭ খ্রিঃ) একটা হিসেব আছে। খনা তাঁর পুত্রবধূ হলে তাঁর সময়টাও পিছিয়ে ষষ্ঠ শতকে চলে যায়। তখন ধন্ধটা বাড়তেই থাকে খনা তাহলে সত্যি কবেকার? নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যেকার? নাকি ষষ্ঠ শতকের?
[ আরও পড়ুন: পালন তো করেন, জানেন অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য?]
খনা নামের কবি ও দুর্ধর্ষ জ্যোতিষীর সঙ্গে বরাহমিহির নামটা মিশে যেসব তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে তার একটা হল খনা বরাহমিহিরের পুত্র মিহিরের নয়, স্বয়ং বরাহমিহিরেরই স্ত্রী ছিলেন। তবে বহুল প্রচলিত ধারণাটা হল খনা তাঁর পুত্রবধূ। পুত্রবধূর জ্যোতিষচর্চার নৈপুণ্যে একসময় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন দেশবরেণ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁর অঙ্গগণনা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের চেয়েও ঢের নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী ফলে উঠছিল খনার জ্যোতিষবিচারে। যে ভবিষ্যদ্বাণী কবি খনা কবিতা করে বলে যেতেন মুখে মুখে। সেই প্রবল বচনশক্তি রদ করতেই নাকি বরাহমিহির পুত্রবধূর জিভ কেটে নেন। আরেক মতে কুকাণ্ডটি ঘটান স্বামী মিহির। তৃতীয় মতে, ভাড়াটে খুনি দিয়ে কাজটা সারা হয়। আর চতুর্থ মতে, প্রবল চাপে ও পুরুষের পীড়নে তিনি নিজেই জিভ কেটে নির্বাচন হয়ে যায়।
[ আরও পড়ুন: অশুভ শক্তি দূরে রাখতে শাস্ত্র মেনে বাড়িতে এভাবেই রাখুন শঙ্খ]
খনার বচন বাংলা সাহিত্যের আদি কীর্তির মধ্যে পড়ে। তাঁর বচন সাহিত্যের মস্ত ভাগ জুড়ে চাষাবাদের তত্ত্বকথা। জ্যোতিষশাস্ত্রে গভীরজ্ঞানী তো ছিলেনই, অধিকন্তু আবহাওয়াদর্শন ও কৃষিবিদ্যারও নানা রহস্য মোচন হত তাঁর বচনে বচনে। এই আধুনিক যুগেও তার অনেক সত্যই সত্য থেকে গেছে। তেমন কিছু চালু নমুনা তুলে দিচ্ছি৷
“যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্যি রাজা পুণ্যি দেশ।”
“ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন
শীঘ্র হবে বৃষ্টি জানো।”
“গাছে গাছে আগুন জ্বলে
বৃষ্টি হবে খনায় বলে।”
“যদি হয় চৈতে বৃষ্টি
তবে হবে ধানের সৃষ্টি।”
“সাত হাতে তিন বিঘাতে
কলা লাগাবে মায়ে পুতে।
কলা লাগিয়ে না কাটবে পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।”
“গাছগাছালি ঘন রোবে না
গাছ হবে তার ফল হবে না।”
“খেত আর পুত
যত্ন বিনে যমদূত।”
[ আরও পড়ুন: কেন রাধার সঙ্গে হোলিতে মেতে উঠেছিলেন কৃষ্ণ?]
খনা নামের বানানটা ‘খ’ দিয়ে। প্রকারভেদে ক্ষনা। কারণ এক আশ্চর্য ক্ষণে তাঁর জন্ম। খনার বংশ নিয়েও নানা কিংবদন্তি। তাঁর পিতা অনাচার্য নাকি ছিলেন রাজা চন্দ্রকেতুর মন্দিরের সেবাইত। আরেক বিবরণে বলছে তিনি ছিলেন সিংহলের (এখনকার শ্রীলঙ্কা) রাজকন্যা। আর সেই মতটাও তো চলে আসছে যে খনা বলে কেউ ছিলেনই না। গ্রামীণ সমাজের প্রচলিত জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা ও গ্রহণযোগ্যতা দেবার এমন এক মানবী চরিত্র সমাজ সৃষ্টি করে নিয়েছে। ইতিহাস, কিংবদন্তি বা কল্পনা যা-ই হোক, খনা এবং তাঁর বচন চিরস্থায়ী হয়েছে। মানবমন ও সমাজের গতিবিধি নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ গায়ে কাঁটা দেয়। চমকে ওঠার মতো এমন তিনটি বচন দিয়ে শেষ করছি –
“তেলা মাথায় ঢালো তেল,
শুকনো মাথায় ভাঙো বেল।”
“ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন
যদিও পৃথক হয়, নারীর কারণ।”
“মেয়ে নষ্ট ঘাটে, ছেলে নষ্ট হাটে।”