Advertisement
Advertisement

‘উচ্চারণের বদল ঘটিয়ে বাংলা গানে বিপ্লব এনেছিলেন’, জন্মশতবর্ষে হেমন্ত-স্মরণ কবীর সুমনের

অনেক শিল্পীকে অর্থসাহায্যও করতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

Kabir Suman recalls Hemanta Mukherjee on his 100 birth anniversary
Published by: Bishakha Pal
  • Posted:June 16, 2020 6:32 pm
  • Updated:June 16, 2020 7:08 pm

ঠিক একশো বছর আগে আজকের দিনে কলকাতার উপকণ্ঠে জন্মেছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি বাংলা গানের জগতে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন। বাংলা আধুনিক গানের কথা বলতে তাঁর কথাই প্রথম মনে পড়ে সংগীতপ্রেমীদের। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukherjee)। আজ, তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে প্রবাদপ্রতীম সেই গায়ককে স্মরণ করলেন কবীর সুমন (Kabir Suman)। শুনলেন বিশাখা পাল।

বাংলা সংগীত প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ। কিন্তু তখনকার গান আর আজকের গানের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। রবি ঠকুর তাঁর শান্তিনিকেতনের শ্যামলীর উঠোনে বসে যখন গান গাইতেন আর আজ যখন সেই রবীন্দ্রসংগীত অন্য কেউ গায়, তার মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। সেদিনের গানে গভীরতা ছিল। কিন্তু শ্রুতিমাধুর্য ছিল না। এর প্রধান কারণ উচ্চারণ। দুই যুগের মধ্যে এই সেতুবন্ধনীর কাজই করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেই কথাই বলছিলেন কবীর সুমন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে অনেক কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। হেমন্তবাবু ছিলেন তাঁর ‘গায়ক।’ কথাপ্রসঙ্গেই কবীর সুমন বলেন, “তাঁর উচ্চারণ শুনে মনে হত তিনি আমার গায়ক। আমার বাবা আমার গানের প্রথম শিক্ষক। কিন্তু আমার গায়ক তিনি হয়ে উঠতে পারেননি কোনওদিন। যা হেমন্তবাবু হয়েছিলেন।”

Advertisement

চলচ্চিত্রের সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়, তবে জহর গাঙ্গুলি, অসিতবরণ, তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার সঙ্গে উত্তম কুমার বা বসন্ত চৌধুরীর মধ্যে যে তফাত গড়ে গিয়েছিল, তা অভিনয় শৈলীর চেয়েও বেশি ছিল উচ্চারণের। বাংলা ভাষাটা কীভাবে বলা হচ্ছে, সেই উচ্চারণের ভঙ্গিমাই দুই যুগের অভিনেতাদের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল। বাংলা গানের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। কবীর সুমনের মতে, “বাঙালি জাতির আধুনিকতার উন্মেষ শুরু হয় উনিশ শতকে। বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথের গানের যে রেকর্ডিংগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো বেশ অন্যরকম। যাঁরা গাইতেন, তাঁরা পরিশীলিত ভাষা ও উচ্চারণের অধিকারী ছিলেন না। এই উচ্চারণগুলো ছিল প্রাচীন সাবেকি উচ্চারণ। তখন ‘ছেয়ে’ উচ্চারণ হত ‘ছেইয়ে’। এমনকী শ্যামল মিত্র পর্যন্ত এই উচ্চারণের প্রভাব এড়াতে পারেনি। তিনের দশকে যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আসেন, তখন উচ্চারণের এই ‘সাবেকিয়ানা’ এড়াতে পারেননি তিনিও। আমার বাবার লেখা অনেক গান গেয়েছিলেন হেমন্তবাবু। কিন্তু সেই গানগুলোতে স্পষ্ট ছিল ‘সাবেকিয়ানা’। এরপর এল চারের দশক। তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় উপর পঙ্কজ মল্লিকের প্রবল প্রভাব। পঙ্কজ মল্লিকের শৈলীগত বদঅভ্যাস ছিল টেনে উচ্চারণ করা। ওই একই বদভ্যাস আমার বাবারও ছিল, হেমন্তবাবুরও ছিল। কিন্তু তিনি নিজেই তার অবসান ঘটালেন। পঁচের দশকে যেন জন্ম হল এক নতুন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের।”

Advertisement

hemanta

[ আরও পড়ুন: লকডাউনে আসানসোলের মিউজিশিয়ানদের পাশে বাবুল, আর্থিক অনুদানের জন্য তৈরি হবে ফান্ড ]

গতানুগতিকতার জাল কেটে বেরিয়ে এলেন তিনি। পালটালেন উচ্চারণ। স্বাভাবিকভাবেই পালটে গেল স্বরপ্রক্ষেপ। এখানেই তিনি বিপ্লব ঘটালেন। উনি পঙ্কজ মল্লিকের আধুনিকীকরণের যুগকে অতিক্রম করে বেরিয়ে যেখানে এলেন, তা সংগীতের এক নতুন যুগ। এই যুগোপযোগিতাই তাঁর সবচেয়ে বড় মৌলিক অবদান। আক্ষেপ করে কবীর সুমন বলছিলেন, “কত ভাল তাঁর কণ্ঠ, তা নিয়ে সবাই বলে। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান যে উচ্চারণ, তা কেউ বলে না। তাঁর পরবর্তীকালে যাঁরা এসেছেন তাঁরাও হেমন্তবাবুর এই প্রভাবে প্রভাবিত।”

ও তো গেল গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অবদান গাথা। কিন্তু মানুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কেমন ছিলেন? অতীতে ডুব দিলেন কবীর সুমন। উঠে এল এক অন্য হেমন্তের কথা। যিনি কৃতজ্ঞ, যিনি উদার, যিনি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আগে দু’বার ভাবেন না। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের যাঁরা শিকড় ছিলেন, তাঁর সংগীত জগতে আসা যাঁরা সম্ভব করে তুলেছিলেন, তিনি শেষদিন পর্যন্ত তাঁদের মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়ে আসতেন তাঁর গাড়ির চালক সনৎদা। ইন্ডাস্ট্রি সকলের প্রিয় ‘সনৎদা’। হেমন্তবাবু যখন রাতবিরেতে ফাংশান সেরে বাড়ি ফিরতেন, তখন এই সনৎদাই তাঁকে অমলেট ভেজে খাওয়াতেন। সেই সময় যাঁদের রোজগার প্রায় ছিলই না, তাঁদের কাছে যেন ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রত্যেককে সাহায্য করতেন তিনি। এতটাই ‘ডাউন টু আর্থ’ ছিলেন। এই প্রসঙ্গেই নিজের জীবনের একটি গল্পও শোনালেন কবীর সুমন। একবার তাঁর বউদি তাঁদের বাড়ি ঘুরতে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন শ্যামল মিত্রের অনুরাগী। কলকাতায় বেড়াতে এসে বায়না ধরেন শ্যামল মিত্রের গান শুনবেন সামনে থেকে। সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় শ্যামল মিত্রকে অনুরোধ করলেন যদি তিনি বাড়িতে এসে একটি গান শোনান। কিন্তু তখন যন্ত্র ছাড়া কাজ করতেন না শ্যামল মিত্র। সেদিনের সেই কথা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছেছিল। এরপর এক রবিবার হঠাৎ তিনি কবীর সুমনের বাড়িতে হাজির। সুধীন্দ্রনাথবাবুকে বললেন, “আপনার বউমা কই? ‘অনিন্দিতা’র শুটিংয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনার বউমাকে দু’টো গান শুনিয়ে যাই।” এমনই ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। জন্মশতবর্ষে তাঁর জন্য রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

[ আরও পড়ুন: লকডাউনে বন্ধ উপার্জন, অভাবে ড্রাইভারের কাজ করতে চাইছেন সংগীতশিল্পী ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ