সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়: সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চস্থ হল রঙ্গলোক প্রযোজিত নাটক ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’। সমরেশ বসুর কাহিনি অবলম্বনে নাটক লিখেছেন শ্রী তীর্থঙ্কর চন্দ। নির্দেশনা শ্রী শ্যামল চক্রবর্তী। টিটাগড় অঞ্চলের লোহা কারখানার শ্রমিক নাওয়াল আগারিয়ার নেতা হিসেবে উত্থানের এই গল্প আসলে সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল যেখানে বিপ্লব এবং বিপ্লব পরবর্তী সময়ের ক্ষমতার রাজনীতি নেতা তথা বিপ্লবের কান্ডারিদেরই বিপ্লবের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যান। ক্ষমতার অলি-গলি-অলিন্দে শুধুমাত্র টাকা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই জারি থাকে। বৃহত্তর জনস্বার্থ সেখানে উপেক্ষিত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই ইতিহাসের পরম্পরা। ক্ষমতার ছাতার তলায় অথবা বাইরে যেখানেই থাকুন, আপনি এই ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
শ্রী শ্যামল চক্রবর্তী এই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য সচেতন নাট্য নির্দেশক যাঁর নাটকে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিজীবনের স্বার্থ ও আদর্শগত দ্বন্দ্ব বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে বারবার। লোহা কাটাই শ্রমিক লছমন আগারিয়ার ছেলে নাওয়াল আগারিয়ার উত্থানের শুরু, শ্রমিক মহল্লা থেকেই বাবা লছমন আগারিয়া স্বাধীনতার আগের আমলে ইংরেজ কোম্পানির ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। শ্রমিকদের দুর্দশার কথা পৌঁছে দিয়েছিল কোম্পানির কর্তাদের কানে। বাবার আদর্শের অনুপ্রেরণাতেই শ্রমিক আন্দোলনে হাতেখড়ি নাওয়ালের। তখন অবশ্য প্রেক্ষাপট পালটে গিয়েছে। স্বাধীন হয়েছে ভারতবর্ষ। বামপন্থী আন্দোলন, নকশালদের উত্থান- ঘটনার ক্রমান্বয়ে নাওয়াল ক্রমশ ছোট শ্রমিক নেতা থেকে ধাপে ধাপে বড় মাপের জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠে। দেশে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সে পৌঁছে যায় পার্লামেন্টে। নাওয়ালের জীবন যাপন পালটে যেতে থাকে। নাওয়াল তাল মেলাতে পারে না।
নাওয়ালের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সঞ্জীব সরকার। তিনি এই সময়ের হাতেগোনা কয়েকজন অভিনেতাদের মধ্যে একজন যাঁর নাম থার্ড বেল পড়ার আগেই দর্শকদের মধ্যে একটা প্রত্যাশা তৈরি করে ফেলে। এবং বলা বাহুল্য অভিনয় ক্ষেত্রে তিনি কখনও নিরাশ করেন না। ভোটে জিতে শ্রমিক মহল্লা থেকে চলে আসার এই ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতার জীবনে খাপ খাওয়াতে না পারা নাওয়ালের হতাশা সঞ্জিব ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত যত্নে অত্যন্ত আদরে। নাওয়ালের এই ছেলে লাল্লু তারই দলের তরুণ কমরেড। সে ব্যবসাদার রামকিষণের ঘনিষ্ঠ, বাবার আদর্শ তার কাছে নিছক বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। লাল্লুকে দেখতে দেখতে প্রবন্ধকার ও লেখক এরিক ফর্মের একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। Fear of freedom বইতে তিনি লিখেছেন- Man become a cog in the vast economic machine. লাল্লুর ভূমিকায় কাজল শম্ভূ অসাধারণ। রামকিষণের ভূমিকায় সুদীপ মুখোপাধ্যায়ও যথাযথ। নাওয়ালের সমসাময়িক সুবিধাভোগী অন্যান্য কমরেডদের দেখে বাস্তবের অনেক চরিত্রের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
নাটকের শেষপর্বে নাওয়ালকে কার্যত একঘরে করে দেওয়া হয়। নাওয়াল ফিরে আসে তার পুরনো ভিটেতে। মাটির কাছাকাছি। গোটা নাটকটিতে ঘটনাক্রম বিবৃত হয়েছে লেখকের লেখনিতে। নির্দেশক তা করেছেন যথাযথ। আলো, মঞ্চসজ্জা নাটকটিতে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। মনে রাখার মতো সংগীত পরিচালনা করেছেন স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়স বেড়ে যাওয়ার একটা মুশকিল আছে। ভাল লাগে অনেক কিছু, তবে মুগ্ধতা আসে না সহজে। রঙ্গলোকের ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’ সেই মুগ্ধতা এনে দিল। অনেক দিন পর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.