Advertisement
Advertisement

Breaking News

Chanakya

চন্দ্রগুপ্তকে বসিয়েছিলেন সিংহাসনে, সেই চাণক্যকেই আগুনে পুড়িয়ে খুন করা হয়! জেনে নিন ইতিহাস

চাণক্যর জীবন যেন ইতিহাসকে পেরিয়েও রোমাঞ্চকর কাহিনি।

The Incredible Story of Chanakya। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:April 22, 2022 10:00 pm
  • Updated:April 23, 2022 3:20 pm

বিশ্বদীপ দে: ছেলে জন্মেছে শ্বদন্ত নিয়ে! এ এক রাজলক্ষণ। যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, অচিরেই এই ছেলে বসবে রাজসিংহাসনে। মায়ের ভয়, রাজা হয়ে যদি আদরের সন্তান ভুলে যায় তাঁকে। কথাটা জানা মাত্রই নিজের দাঁত ভেঙে ফেলল ছেলে। তবু রাজক্ষমতা থেকে দূরে থাকা হয়নি তাঁর। রাজা তিনি হননি বটে, তবে হয়েছিলেন রাজ-নির্মাতা। আজকের চালু লব্জে ‘কিং মেকার’। এরপর পেরিয়ে গিয়েছে হাজার হাজার বছর। ইতিহাস ও লোকশ্রুতির মিশেলে আজও এদেশের হাওয়ার ভিতরে রয়ে গিয়েছেন তিনি। বিষ্ণুগুপ্ত ওরফে কৌটিল্য ওরফে চাণক্য (Chanakya)। তাঁর রাজনীতি, দর্শন এবং সর্বোপরি আশ্চর্য জীবন- দীর্ঘ সময়ের সরণি পেরিয়েও লোকজীবনের অঙ্গ হয়ে রয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ‘অর্থশাস্ত্র’ আর ‘নীতিশাস্ত্র’ আজও আলোচিত হয়ে চলে অবিরত। যার ভিতরে থাকা রাজধর্ম ও রাজনীতি সংক্রান্ত বার্তাগুলির প্রাসঙ্গিকতা ফুরোয়নি আজও।

ইতিহাস বলছে তক্ষশীলায় ৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্ম হয়েছিল চাণক-পুত্র চাণক্যের। মৃত্যু ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাটলিপুত্রে। এক সাধারণ পরিবারের সন্তান হিসেবে রাজনৈতিক কৌশলী, দার্শনিক, রাজ উপদেষ্টা হয়ে ওঠার কাহিনি নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত। তবে পার্থক্য যাই থাক, ইতিহাসের বুকে মিশে থাকা জীবনকে বুঝে নিতে সমস্যা হয় না। আসলে সেই অর্থে লিখিত ইতিহাস সামান্যই। মূলত চারটি গ্রন্থকে পাঠ করে সেই মহাজীবনকে বুঝে নিতে চেয়েছেন মার্কিন (US) ইতিহাসবিদ থমাস ট্রটম্যান। যার অন্যতম বিশাখদত্তের জনপ্রিয় নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’। এছাড়া বৌদ্ধ, জৈন ও কাশ্মীরি তিনটি গ্রন্থ রয়েছে। থাক, সেই সব বিবরণ। ঢুকে পড়া যাক চাণক্যের জীবনগাথায়। যা এই বইগুলিতে রয়েছে। তবে নানা ফারাক রয়েছে, সেকথা আগেই বলেছি।

Advertisement

 

Advertisement
Chanakya
ছোটপর্দায় চাণক্য

[আরও পড়ুন: EXCLUSIVE: অরুণ লালের সঙ্গে কীভাবে আলাপ? মুখ খুললেন হবু স্ত্রী বুলবুল সাহা]

শুরুতে যে দাঁত ভেঙে ফেলার কথা বলা হয়েছে সেটি বৌদ্ধ গ্রন্থটিতে রয়েছে। আবার জৈন গ্রন্থটির বর্ণনা, চাণক্য জন্মেছিলেন ৩২ পাটি দাঁত নিয়েই। সন্ন্যাসীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই ছেলে ভবিষ্যতে রাজা হবেই। বাবা ভয় পেয়ে ছেলের দাঁত ভেঙে দেন। অর্থাৎ দাঁত ভাঙার বিষয়টি থাকছেই।

বাহ্যিক চেহারায় যতই ‘অসুন্দর’ হোন না কেন, চাণক্য ছোট থেকেই ছিলেন মেধাবী। তক্ষশীলা থেকে অধ্যয়ন শেষ করে সেখানেই শিক্ষকতা করেছিলেন। কিন্তু চাণক্যর জীবনের আসল কাহিনি শুরু হয় ধননন্দের রাজসভা থেকে। মগধের সম্রাট তখন ধননন্দ। অত্যাচারী, আমোদগেঁড়ে রাজাকে নিয়ে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সেই দুর্বিনীত ধননন্দের কাছেই তুমুল অপমানিত হতে হয়েছিল চাণক্যকে। যে অপমান কেবল ধননন্দের জীবনই নয়, মগধ তথা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসকেই বদলে দেবে পরের বছরগুলিতে।

কেন অপমানিত হতে হয়েছিল চাণক্যকে? এখানেও নানা কাহিনি। একটা কাহিনি বলছে, ব্রাহ্মণদের দানধ্যান করতেন ধননন্দ। সেকথা জানতে পেরে তাঁর কাছ থেকে অনুদান নিতে গিয়েছিলেন চাণক্য। তখনও রাজা আসেননি দরবারে। অপেক্ষমাণ চাণক্য নাকি ভুল করে রাজসিংহাসনেই বসে পড়েছিলেন! যার জেরে তাঁকে রীতিমতো লাথি মেরে ফেলে দেওয়া হয় মাটিতে। আবার আরেক কাহিনি বলছে, ‘অসুন্দর’ চাণক্যকে দেখে বিরক্ত হয়ে রাজাই নাকি তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবার ‘মুদ্রারাক্ষস’ বলছে, রাজার পারিষদদেরই একজন হয়ে গিয়েছিলেন চাণক্য। কিন্তু পরে তাঁকে সেই পদ থেকে বহিষ্কার করেন ধননন্দ। অর্থাৎ, কাহিনি যতই আলাদা আলাদা হোক, চাণক্যর অপমানিত হওয়ার ঘটনাটি ‘কমন’। এবং ক্ষোভে ফুঁসে উঠে বাঁধা চুল খুলে দিয়ে নন্দ বংশের পতন ঘটানোর প্রতিজ্ঞাও।

Taxila
তক্ষশীলা: আজও এক বিস্ময়

[আরও পড়ুন: SSKM হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন অনুব্রত, বিশ্রামের পরামর্শ চিকিৎসকদের]

অপমানিত চাণক্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এমন কাউকে যে হয়ে উঠবে মগধের পরের সম্রাট। এরপরই জঙ্গলের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে ‘রাজা রাজা’ খেলতে থাকা এক বালককে চোখে পড়ে তাঁর। ছোট্ট ছেলেটির বিচার বিবেচনা ও আত্মবিশ্বাস দেখে চাণক্যের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এই ছেলেই পারবে তাঁর স্বপ্নকে সার্থক করতে। একটি কাহিনি বলছে, এই সময়ে চাণক্য়ের সঙ্গে ছিল আরেক জন। সে ধননন্দের ছেলে পর্বত। তারও লক্ষ্য ছিল রাজসিংহাসন। বাবার লুকনো ধনসম্পদের হদিশ দিয়ে সে চাণক্যের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠলেও চাণক্য তাঁকে পরবর্তী রাজা হিসেবে গড়ে তুলতে খুব একটা ইচ্ছুক ছিলেন না। তবু ফেলতে না পেরে সঙ্গে রেখেছিলেন। চন্দ্রগুপ্তকে পেয়ে চাণক্য অবশ্য নিঃসংশয় হন, পর্বত বা অন্য কেউ নয়, মগধের পরবর্তী রাজাধিরাজকে তিনি পেয়ে গিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত তক্ষশীলায় নানা বিষয়ে শিক্ষিত হয়ে বহু চেষ্টা ও কৌশলে ধননন্দকে পরাজিত করে মগধরাজ হন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। কিন্তু পর্বত? সে এক নিষ্ঠুর আখ্যান। সেই সময় চন্দ্রগুপ্ত ও পর্বতকে নিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন চাণক্য। এসে উঠেছেন কাশীতে। সেই সময় এক ধনী ব্যক্তির থেকে দুটো সোনার হার উপহার পান ছদ্মবেশী পর্বত ও চন্দ্রগুপ্ত। ‘গুরু’ চাণক্য দিলেন কঠিন এক কাজ। ঘুমন্ত চন্দ্রগুপ্তকে না জাগিয়ে গলা থেকে সরিয়ে আনতে হবে হার। পর্বত পারবেন না। কিন্তু একই কাজ চন্দ্রগুপ্ত করে ফেললেন। নিঃশব্দে। আসলে ঘুমন্ত পর্বতের গলা কেটে হার সরিয়ে নিয়ে এসেছিল কিশোর চন্দ্রগুপ্ত! রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের পিছনে যে রক্তের দাগের আলপনা, তা যে যুগ যুগ ধরে সভ্যতার সঙ্গী, সেকথা আবারও মনে পড়ে যায়।

কিন্তু যে চন্দ্রগুপ্তকে রাজসিংহাসনে বসালেন চাণক্য, তাঁরই খাবারে কেন বিষ মেশাতেন তিনি? এও এক আশ্চর্য কাহিনি। আসলে চাণক্য শত্রুর সম্ভাব্য চক্রান্ত থেকে সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্তকে। আর তাই রোজ খাবারে অল্প করে বিষ মিশিয়ে দিতেন। যাতে রাজার শরীর বিষ-সহ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই কাজই একদিন ডেকে আনল বড় বিপদ। সেই সময় গর্ভবতী রাজমহিষী দুর্ভারা। তাঁর গর্ভে ভাবী রাজা বিন্দুসার। চন্দ্রগুপ্তর শখ হল, স্ত্রীর সঙ্গে একই থালায় খাবার খাবেন। তিনি তো আর জানতেন না, খাবারে মেশানো রয়েছে বিষ! সেই বিষই দুর্ভারার শরীরকে বিষিয়ে দিল। খবর পেয়েই হাজির রাজার অমাত্য চাণক্য। দ্রুত তরোয়াল চালিয়ে রানির গর্ভ থেকে রাজার সন্তানকে বের করে আনলেন তিনি। কারণ বিষে জর্জরিত দুর্ভারা যে আর বাঁচবেন না, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। এই কাহিনিরও রকমফের রয়েছে। তবে মোটের উপর সেটা এরকমই।

এই ঘটনাই পরবর্তী সময়ে বিন্দুসারের মনে জাগিয়ে তুলেছিল তীব্র রাগ! আসলে ততদিনে সংসার ত্যাগ করেছেন বৃদ্ধ চন্দ্রগুপ্ত। জৈন মতে উপবাসের মাধ্যমে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। সম্রাটের আসনে বসা বিন্দুসারকে সুবন্ধু নামের এক ব্যক্তি খেপিয়ে তুললেন। আসলে চাণক্যকে সরিয়ে ওই আসনে নিজেকে বসাতে চায় দুর্বৃত্ত সুবন্ধু। এই খবর এসে পৌঁছল চাণক্যের কানেও। এমনিতেই চন্দ্রগুপ্তের প্রয়াণের পর থেকে তাঁর মন ভেঙে গিয়েছে। এখন এই চক্রান্তের সামনে দাঁড়িয়ে আর প্রতিরোধ গড়তে ইচ্ছে হল না। স্বেচ্ছামৃত্যুর বেদী তৈরি করে ফেলে জীবনকে শেষ করতে উদ্যত হলেন। শেষ মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত হলেন বিন্দুসার। এক বৃদ্ধা দাসীর কাছ থেকে তিনি সব জানতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন, কীভাবে এই মানুষটি সেদিন নিজের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে তাঁকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন।

তরুণ সম্রাটের ভুলের অবসানে চাণক্যের ঠোঁটের ডগায় হাসি ফুটে উঠলেও তা স্থায়ী হয়নি। শেষ পর্যন্ত কুচক্রী সুবন্ধুর লাগিয়ে দেওয়া আগুনে দাউদাউ জ্বলে উঠেছিল ধ্যানবেদী। অনেক চেষ্টাতেও আর বাঁচানো যায়নি চাণক্যকে। তাঁর দগ্ধ শরীর নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। রাজক্ষমতা ও তার পরিপার্শ্ব যে সর্বক্ষণ এক চক্রান্ত ও রক্তদাগের আবহকে বয়ে নিয়ে চলে, তা যেন চাণক্যের জীবনের অন্তিম লগ্নেও এভাবেই ফুটে রইল। যদিও আরেক মতে, চাণক্যও নাকি চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গেই নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছিলেন উপবাসের মাধ্যমে। তবুও যাঁর জীবনে চমকের পর চমক, তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ে এই চক্রান্তের আখ্যানই যেন সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ