ছবি: প্রতীকী
অভিরূপ দাস: ‘মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা।’ শুধু পুরুষ মানুষের পরাক্রম জাহির করতে গিয়ে এ হেন লবজ আওড়ালে ভুল হবে। কারণ, কয়েকজন কন্যার ক্ষেত্রেও যে কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি! যেমন, ছ’বছরের আর্শিয়া (নাম পরিবর্তিত)। ছোট থেকে তার শারীরিক যন্ত্রণাবোধ বা শীত, গরমের অনুভূতি গায়েব। গায়ে সূঁচ ফুটিয়ে দিলে কেঁদে ওঠে না, আঙুল পুড়ে গেলেও টের পায় না। জন্মসূত্রে পাওয়া বিরলতম যে দূরারোগ্য অসুখ তাকে এই ‘সহ্যক্ষমতা’ দিয়েছে, তার পোশাকি নাম ‘কনজেনিটাল ইনসেনসিভিটি টু পেন উইথ এনহাইড্রোসিস’, সংক্ষেপে CIPA। জিনঘটিত এই ব্যাধি চোট-আঘাত ছাড়াও অন্যান্য অনুভূতিকে নষ্ট করে দেয়। তাই ঘোর গ্রীষ্মেও আর্শিয়ার একফোঁটা ঘাম হয় না!
এ হেন ‘সুপারগার্ল’-এর বাড়ি কলকাতার পার্ক সার্কাসে। আপাতত ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে (ICH) চিকিৎসাধীন। অনুভূতি না থাকার অসুখই যে একরত্তি মেয়েটার মহা বিপদ ডেকে এনেছে। কী রকম? মাস চারেক আগে খেলতে খেলতে মেয়ে পায়ে চোট পেয়েছিল। বাবা মহম্মদ আফজল জানিয়েছেন, খোঁচা ওঠা পাথরের আঘাতও সে বুঝতে পারেনি। অনুভূতিই যে নেই! পায়ের ক্ষত বাড়তে বাড়তে গোড়ালি পর্যন্ত চলে যায়। হাঁটতে পারছিল না। কিন্তু ওইটুকুই, তা নিয়ে মেয়ে মোটেই কান্নাকাটি করেনি। এরপর মেয়েকে নিয়ে ২৪ জুলাই পার্ক সার্কাসের ওই শিশু হাসপাতালে আসেন আফজল। পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, ব্যথার অনুভূতি না থাকার নেপথ্য কারিগর হল CIPA। যে রোগ তার সমস্ত যন্ত্রণার অনুভূতি কেড়ে নিয়েছে। শরীরের অনুভূতি বহনকারী নার্ভগুলো তো ঘুমিয়ে রয়েছে!
ফলে বিপদের হাতছানি পদে পদে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রভাসপ্রসূন গিরির ব্যাখ্যা, “এই অসুখে কোনও ক্ষত সারতে তিন গুণ সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে – চারকট জয়েন্ট। এনটিআরকে১ জিনে মিউটেশনের কারণেই শরীরে বাসা বাঁধে এই অসুখ। এখনও এর কোনও চিকিৎসা নেই।” তবু হাল ছাড়ছেন না ICH-এর ডাক্তারবাবুরা। আপাতত পায়ের ক্ষতর শুশ্রূষা চলছে। ঘাম হয় না বলে এই ধরনের রোগীরা প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না।
বস্তুত মেয়ে যে আর পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক নয়, তার আঁচ আর্শিয়ার জন্মের পরেই পেয়েছিলেন আফজল। আঙুল মুখে দিয়ে কামড় পড়লে বাচ্চারা সচেতন হয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু তাঁর মেয়ে কাঁদত না। ব্যথার অনুভূতি না থাকায় আঙুল কামড়ে রক্তারক্তি করত। আফজলের কথায়, “মেয়ের গায়ে মশা বসে থাকে। আমরা বলি, মশা কামড়াচ্ছে, মার। ওর হুঁশই নেই! আঙুল কামড়ে যে রক্ত বার করছে, তা-ও খেয়াল নেই!” চিকিৎসকরা বলছেন, এই ধরনের সেল্ফ মিউটিলেটিং বিহেভিয়ার CIPA রোগীদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বাভাবিক। ICH-এ চিকিৎসাধীন আর্শিয়ার পায়ের ক্ষত সারতে দীর্ঘ সময় লাগবে। অনেকদিন ধরে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হবে। মূল রোগের নিরাময় না থাকলেও পায়ের ক্ষত কিংবা হাড়ের জয়েন্টের সমস্যা সারাতে চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
ভয় রয়েছে আরও। এমন রোগীদের হঠাৎ হঠাৎ জ্বর চলে আসে। তা থেকে খিঁচুনি হতে পারে। সে দিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে। সুপারগার্লের বেঁচে থাকার লড়াই যাতে শেষ না হয়ে যায়, সেটাই এখন চ্যালেঞ্জ ডাক্তারবাবুদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.