ব্রতীন দাস, শিলিগুড়ি: শীত এলেই মন উসখুশ করে তার জন্য। বাজারে দেখামাত্র ছোঁয়া মেরে তুলে নিতে ইচ্ছে হয়। কারণ, তাকে ছাড়া যে পৌষের মিঠে রোদ গায়ে মেখে আড্ডা জমে না। ফলে দাম যা–ই হোক না কেন, পিঠে–পুলি–পায়েস, জয়নগরের মোয়ার সঙ্গে ফি বছর শীতে দার্জিলিংয়ের কমলা যেন ‘মাস্ট’। কিন্তু যার ‘প্রেম–এ বুঁদ হয়ে চড়া দরে তাকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, তা আদৌও দার্জিলিংয়ের কমলা তো? কি খটকা লাগছে নিশ্চয়! দার্জিলিংয়ের কমলালেবু নিয়ে লোক ঠকানোর কারবার নিয়ে আমাদের এই প্রতিবেদন।
[শিকেয় সরকারি সুবিধা, অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবাতেও দেদার কালোবাজারি]
আসল-নকল
আসল খবরটা জেনে রাখুন। টানা চার মাসের বনধের জেরে গাছের পরিচর্যা না হওয়ায় এবার পাহাড়ে কমলার ফলন একেবারেই কম। আর সেই সুযোগে রাজ্যের বাজার ছেঁয়ে গিয়েছে ‘কিন্নো’। দেখতে হুবহু আর পাঁচটা কমলালেবুর মতো। বরং অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি চকচকে, ঝকঝকে। সেই রূপেই ক্রেতাদের চোখ টানছে সে। বিক্রিও হচ্ছে ভাল দামে। কিন্তু বাড়িতে নিয়ে এসে আয়েশ করে খাওয়ার সময় খোসা ছাড়াতে গেলেই বেরিয়ে পড়ছে তার আসল চেহারা। তখন আর কিচ্ছু করার নেই। কারণ, রূপে যাই হোক না কেন, স্বাদে দার্জিলিংয়ের কমলার ধারে কাছেও নেই পাঞ্জাবের এই লেবু। সব জেনেও ব্যবসার স্বার্থে মুখ বুজে থাকছেন বিক্রেতারা।
[কেজি প্রতি ভরতুকি, সার কিনতে গিয়ে প্রতারণার ফাঁদে কৃষকরা]
নাগপুরের কমলা, ভুটানের কমলা কিংবা মেঘালয়ের ‘খাসি’ কমলা তো বাজারে রয়েইছে। দার্জিলিং কমলার সঙ্গে পার্থক্য করতে না পেরে অনেকে সেসব বাজার থেকে কিনেও নিয়ে যান। কিন্তু খোসা ছাড়িয়ে কোয়া মুখে দিতেই তাদের ভুল ভাঙে। কিন্তু এবার গোটা বাংলা জুড়ে এত বিপুল পরিমাণে পাঞ্জাবের কিন্নো ছড়িয়ে পড়েছে যে, দার্জিলিংয়ের কমলা ভেবে ঠকতে হচ্ছে বহু মানুষকে।
[সরকার পাঠাচ্ছে খাদ্যসামগ্রী, কোন চক্র উধাও করছে রেশনের চাল-গম?]
কী এই ‘কিন্নো’?
এটি কমলালেবুরই একটি জাত। তবে হাইব্রিড। ‘কিং’ ও ‘উইলো লিফ’ নামে লেবু জাতীয় দু’টি ফলের প্রজাতির সঙ্গে সংকরায়ণের ফলে তৈরি হয়েছে ‘কিন্নো’। জানিয়েছেন উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক–গবেষক ড. নীলেশ ভৌমিক। ১৯৩৫ সালে এটির উদ্ভাবন হলেও ভারতে আসে ১৯৭০ নাগাদ। তবে ইদানীং শুধু পাঞ্জাব নয়, হরিয়ানা ও রাজস্থানেরও একটি অংশে প্রচুর পরিমাণে ‘কিন্নো’–র চাষ হচ্ছে।
কী দেখে চিনবেন দার্জিলিং কমলা আর ‘কিন্নো’–কে?
উদ্যানপালন বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, দার্জিলিং কমলা সাইজে কিন্নোর তুলনায় ছোট। তা ছাড়া দার্জিলিং কমলার খোসা পাতলা। কিন্তু কিন্নোর খোসা মোটা। দার্জিলিং কমলায় খোসা ছাড়ালে সহজেই কোয়া আলাদা করা যায়। কিন্তু কিন্নোর কোয়া খোসার সঙ্গে এমনভাবে লেগে থাকে যে, সহজে আলাদা করা যায় না। সবচেয়ে বড় পার্থক্য, দার্জিলিং কমলা সুমিষ্ট। কিন্তু কিন্নো টক। দার্জিলিং কমলার খোসার গায়ে সুঁচের মতো ছিদ্র থাকে। কিন্তু কিন্নোর গা একেবারে মোমের মতো মসৃণ। জুস হিসাবে ব্যবহারের জন্যই মূলত কিন্নোর চাষ শুরু হয়। অন্যদিকে, গত কয়েক বছর ধরেই দার্জিলিং কমলার ফলন কমছে। কিন্তু এবার গুরুং বাহিনীর ডাকা টানা বনধের জেরে ফল ধরার সময় কমলা বাগানে কোনও পরিচর্যাই করতে পারেননি চাষিরা। তারই জেরে ৭৫ শতাংশ ফলন কম হয়েছে। মিরিক কিংবা কার্শিয়াংয়ের সিটং থেকে যেটুকু কমলা আসছে, তাতে কার্যত হাত ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। পাইকারি বাজারে দশ টাকার কমে মিলছে না দার্জিলিং কমলা। খুচরো বাজারে কোথাও ১২–১৩ টাকা, কোথাও তা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ১৫ টাকায়।
পাহাড় থেকে নেমে প্রথমে শিলিগুড়ির নিয়ন্ত্রিত বাজারে জমা হয় দার্জিলিং কমলা। তার পর ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে। কিন্তু এখন দিনে দু–তিন ট্রাকের বেশি কমলা ঢুকছে না। ফলে তা সর্বত্র পৌঁছাচ্ছে না। ডুয়ার্সের গরুবাথানে কিছু কমলার চাষ হয়। কিন্তু এবার সেখানেও বিপত্তি। এমনিতেই ফলন কম। তার উপর যতটুকু ফল ধরেছে, তাতে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। ফলে সেই কমলা কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না আড়তদাররা। স্বাভাবিকভাবে পুণম রাই, কমল বিশ্বকর্মার মতো কমলা চাষিদের মাথায় হাতে। তাদের সর্বনাশের সুযোগে দার্জিলিংয়ের কমলা বলে কিন্নোকে চালাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অতএব একটু দেখে কিনুন। কমলালেবু যেন টক না হয়ে যায়।
[ঘিতে মিশছে রাসায়নিক-চর্বি, কীভাবে ভেজাল ধরবেন?]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.