Advertisement
Advertisement
করোনা

‘চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা’, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ইটালি থেকে লিখলেন বালিগঞ্জের মেয়ে

রাস্তায় বেরোলেই ১৩৫ ইউরো জরিমানা করছে ইটালি।

Bullygunj girl shares her experience about corona situation from Italy
Published by: Bishakha Pal
  • Posted:March 25, 2020 1:20 pm
  • Updated:March 25, 2020 2:37 pm

স্বাতী চৌধুরি, মিলান: জর্জকে বিয়ে করে যখন পাকাপাকিভাবে ইটালি চলে এলাম, তখন কি ভেবেছিলাম, দেশজুড়ে এই মৃত্যু মিছিল একদিন প্রত্যক্ষ করতে হবে? প্রতিটি সকাল শুরু হয় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। চোখ খুলেই ভাবি, না জানি আজ আবার কী দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে!

পশ্চিমবঙ্গকে আপনারা যেমন ‘রাজ্য’ বলেন, ইটালিতে বলা হয় ‘প্রভিন্স’। বিভিন্ন প্রভিন্সে আমাদের কত বন্ধু ও আত্মীয় যে কী অসহায়তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে, বোঝাতে পারব না। হ্যান্ডশেক-দূরত্ব থেকে মৃত্যুকে এভাবে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা শুধু প্রত্যক্ষদর্শীরাই বলতে পারবেন। অথচ এই মর্মান্তিক বেদনা অনুভব করার মতো পরিস্থিতিই ছিল না আমাদের।

Advertisement

মিলানের সেন্ট্রালে বাড়ি আমার। এখান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দুই গেলেই সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত। জর্জকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে কতবার চলে গিয়েছে সেখানে। কিন্তু এখন সেসবই স্বপ্নের মতো লাগে। জানি না, ফের কবে সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হবে।

Advertisement

মিলান হচ্ছে ফ্যাশনদুরস্ত মানুষদের পীঠস্থান। ইটালির মূল বাণিজ্যকেন্দ্রও বলা যায়। সারা পৃথিবীর শৌখিন ও ফ্যাশন-প্রিয় মানুষের ভিড়ে বছরের সারাটা সময় গমগম করে মিলানের রাস্তাঘাট। আর এখন চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। বসন্ত হলেও এখনও ঠান্ডাটা যায়নি। তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করছে এই ১০ ডিগ্রির আশপাশে। জ্যাকেট পরে ঘরের মধ্যে বসে আছি। আইসোলেশনে আছি বলাই ভাল।

ballygunj-girl

[ আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কের মাঝেই নতুন বিপর্যয়, তীব্র ভূমিকম্পের ফলে রাশিয়ায় জারি সুনামির সতর্কতা ]

বালিগঞ্জের মেয়ে আমি। বিবাহসূত্রেই দীর্ঘদিন মিলানে আছি। অবরে-সবরে কলকাতা যাই। কিন্তু এখন, অষ্টপ্রহর, মন পড়ে আছে সেই কলকাতায়। বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকা তিনজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সামলাতে হচ্ছে মিলানের এই আইসোলেশনের ঘেরাটোপে থেকেই। তবে ওদের আমি সামলাব কী, বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকা আমার বৃদ্ধ কাকুর মতো অন্য গুরুজনও বেশি চিন্তিত আমার জন্য। আপনারা নিশ্চয় প্রতিদিন খবর পাচ্ছেন- করোনা ভাইরাসের প্রকোপে ইটালির ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা। সবাই চিন্তিত ইটালির কথা ভেবে। আমার যদিও মনে হয়, শুরুর দিকে ইটালির মতো সারা বিশ্বও যদি করোনা নিয়ে সামান্য সতর্ক থাকত, তাহলে এই মৃত্যুমিছিল এড়ানো যেত।

milan

চিনে যখন প্রথম করোনা ভাইরাসের প্রভাব চোখে পড়ে, তখন ডিসেম্বরের শেষ। সত্যি করে বলুন তো, তখন ভারতেও কি এ নিয়ে কোনও সতর্কতা ছিল? COVOD-19 নিয়ে বিশ্বের টনক নড়ল জানুয়ারির শেষের দিকে, যখন চিন প্রথম সরকারিভাবে ঘোষণা করল। ততদিনে চিনের সঙ্গে ব্যবসা-সহ নানা সূত্রে এই মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আমাদের ইটালিও যার বাইরে নয়।

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ‘প্রভিন্স’ লম্বার্ডির উত্তরে প্রথম এক ব্যক্তির করোনা ভাইরাস নিয়ে পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। তিনি কিন্তু বৃদ্ধ ছিলেন না। ৩০-৩৫ বছর মতো বয়স হবে। সেই শুরু। পরের দিনই জানা গেল, ভেনেতো প্রভিন্সে আরও কয়েকজনের ‘পজিটিভ’ ফল এসেছে। ভেনিস হচ্ছে ভেনেতো প্রভিন্সের রাজধানী। এরপর ধীরে ধীরে ইতালির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর আসতে শুরু করে দেয়, যা এখন মহামারির আকার ধারণ করেছে। এর একটাই কারণ, আমরা কেউই শুরুতে এই মহামারি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এই মুহূর্তে সারা দেশে মৃত্যুর সংখ্যা কত, এমনকী আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কত, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রোজ নানারকম গুজব ছড়াচ্ছে ইটালিতে। তবে আমরা গুজবের থেকেও বেশি চিন্তিত কীভাবে মিলিতভাবে সমস্যা প্রতিরোধ করব, তা নিয়ে।

[ আরও পড়ুন: থামছে না মৃত্যু মিছিল, বিশ্বজুড়ে করোনার বলি সাড়ে ১৮ হাজারেরও বেশি ]

শেষ ১৫ দিন ধরে, সারা দেশে ‘লকডাউন’ জারি হয়েছে। রাস্তায় মিলিটারি, পুলিশ টহল দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ছেড়েছে। কিন্তু এখন সব বন্ধ। নিয়ম হয়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য একদম সামনের সুপার মার্কেটে যেতে হবে। ধরুন, আপনার বাড়ি যাদবপুর। আর আপনি জিনিস কিনতে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন নিউ মার্কেট- এরকম করার সুযোগই নেই। তাই গাড়ি চলাচল পুরো বন্ধ। ট্রেন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এরপরেও রাস্তায় বেরলে পড়তে হবে কড়া পুলিশি জেরার সামনে। যদি আপনি প্রমাণ করতে না পারেন, সত্যিই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস অথবা ওষুধ কিনতে বেরিয়েছেন, তাহলে ভারি বিপদ! সঙ্গে সঙ্গে কম করে ১৩৫ ইউরো জরিমানা। তাই দরকার ছাড়া কেউই বাড়ির বাইরে পা রাখছেন না। অফিসের কাজ চলছে সব বাড়ি থেকে। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। সংবাদমাধ্যম খোলা। তবে চেষ্টা চলছে, যতটা সম্ভব বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য। যাঁদের অফিস যেতেই হবে, অফিসে একজনের সঙ্গে অন্যজনের দূরত্ব কম করে ৩ মিটার। আমি ‘বিজনেস ইংলিশ’ পড়াই। শেষ ১৫ দিন বাড়িতে বসে অনলাইনেই পড়াচ্ছি।

milan-1

বাড়ি থেকে না বেরলে কী হবে, ইটালিতে সবাই নিজেদের মধ্যে অনলাইনে যোগাযোগ রাখছে। অনলাইনে যদি অন্যদের কোনওভাবে সাহায্য করা যায়! সবাই তা-ই করছেন। আমি যেমন এখন অনলাইনে যোগা শেখাচ্ছি।

আরও একটা কথা বলার। সুপার মার্কেটে এখনও কিন্তু কোনও জিনিসের টান পড়েনি। এই ব্যাপারটায় সরকার অত্যন্ত কঠোরভাবে পদক্ষেপ করছে। সরকারের নির্দেশে, বাড়িতে থাকার সময় বারবার করে ৩০ সেকেন্ড ধরে ভালভাবে হাত ধুচ্ছি কোহল-সমৃদ্ধ সাবান দিয়ে। বাইরে বেরলে, স্যানিটাইজার আর মাস্ক বাধ্যতামূলক। এককথায়, ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছি আমরা। চারিদিকে চরম আতঙ্কের পরিবেশ। খালি মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব কেন আরও একটু আগে সতর্ক হল না! এর কোনও ওষুধ নেই। ফলে পুরো ইটালিতে চেষ্টা চলছে কোয়ারেন্টাইনের মাধ্যমে যতটা সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার।

এছাড়া, এই মুহূর্তে আর কীই-বা করতে পারি আমরা! আপনারাও, প্লিজ, বাড়ি থেকে বেরবেন না। প্রকৃতির কাছে আমরা সত্যিই বড় অসহায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ