রোমিকা সাহা, নিউ জার্সি: কলকাতার নিউটাউনের সঙ্গে আমেরিকার এই নিউ জার্সি শহরের আজ আর কোনও তফাত নেই। ওখানকার চায়ের দোকানের সঙ্গে আমাদের নিজেদের মেগা রেস্তোরাঁ ওল্ড ব্রিজ এশিয়ান বুফে-র কেনাবেচার কোনও ফারাক নেই। মহাশক্তিধর আমেরিকায় চাকরি-বাস করতে এসেছিলাম উন্নত জীবন কাটাব বলে। কিন্তু মার্কিন সংস্কৃতির ধাক্কা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব না মানায় মৃত্যুর হার কী হারে বাড়ছে। আজ কারও সঙ্গে দেখা হলেই জাপটে ধরে গালে গাল ঠেকিয়ে চুমু খাওয়ার সৌজন্য কতটা বিপজ্জনক। একটা কথা স্পষ্ট, কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রমাণ করে দিল ‘শক্তিমান’ ট্রাম্প (Donald Trump) আমাদের রাজারহাটের পঞ্চায়েত প্রধানের থেকেও বেশি অসহায়।
চিনে যখন করোনা মহামারি আকার নিয়েছিল তখন নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো আর আমাদের নিউ জার্সি শহরের ক্লাবগুলিতে সবাই ফুৎকারে এই ভাইরাসের ক্ষমতাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর পর ফেব্রুয়ারিতেই নিঃশব্দে যখন ভাইরাস ঢুকে পড়ল, তখনও মার্কিনিদের হুঁশ ফেরেনি। বলতে লজ্জা হয়, মার্চ মাসের দ্বিতীয় রবিবার যখন আমার বাড়িতেই নিউ জার্সির বাঙালিদের গেট টুগেদার হয়, তখনও এই ভাইরাস নিয়ে সরকার খুব একটা কড়াকড়ি করেনি। অবশ্য তখনই বেশ কিছু স্কুলের বাচ্চা মারা গিয়েছে। তেমনই অনেক প্রদেশে বয়স্করা মরতে শুরু করেছে। কলকাতায় যেদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কোভিড-১৯ নিয়ে লকডাউনের ঘোষণা করলেন, তার দিন দুয়েক আগে হুঁশ ফিরেছিল ট্রাম্প প্রশাসনের। সোজা কথায়, শ’খানেক মানুষ মারা যাওয়ার পর আমেরিকায় লকডাউন চালু হয়েছে। এটা হওয়া উচিত ছিল তারও অন্তত আরও দু-তিন সপ্তাহ আগে। একটা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন জাতির কথা আজ কলকাতার মানুষকে জানাতেই হবে। তা হল, যখন নিউ ইয়র্ক বা নিউ জার্সির স্কুলের বাচ্চারা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, তখনও এখানকার খুব বিখ্যাত সি-বিচ স্যান্ডউইক পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা। আমাদের বাড়ির খুবই কাছে লরেন্স হারবার। দিনকয়েক আগেও সেখানে দেখেছি, উইকএন্ডে মানুষ গিজগিজ করছে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রশাসনের তরফে যদি এই কড়াকড়ি আগে নেওয়া হত তবে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যায় আমেরিকা শীর্ষে থাকত না। এখানকার বাঙালিরা কটাক্ষ করে বলছেন, মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিত্বের সরস্বতীর চেয়ে লক্ষ্মীর প্রতি ঝোঁক বেশি থাকায় করোনার বিপদ আগে থেকে অনুমান করতে পারেননি। তাই এতটা মহামারি হচ্ছে।
একটা প্রশ্ন প্রায়ই সাগরপাড়ে বসে শুনছি, ভারতে কেন এত কম মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে? এ নিয়ে মার্কিন অনেক নামী পত্র-পত্রিকার অনলাইন এডিশনেও লেখা কাঁচা শাকসবজি এবং অর্ধেক সিদ্ধ খাবার খেতে বেশি পছন্দ করে, তাই এদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। কাঁচা সবজির মাধ্যমে শরীরে একদিকে যেমন ভাইরাস ঢুকে পড়ছে, তেমনই কৃত্রিম উৎপাদনে ব্যবহৃত হরমোন ও রাসায়নিক পেটে গিয়ে ক্ষতি করছে। আমাদের ভারতীয়দের শরীরে ভিটামিন-ডি বেশি থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। আর আমরা বাঙালিরা তো ধুলোমাটি খেয়ে, প্যাচপেচে গরমে ট্রামে-বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে চলাচল করে অভ্যস্ত। তাই আমাদের জিনগত ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতাও বেশি। উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, বছরের একটা বড় সময়ে আমেরিকার এই অংশে খুব ঠান্ডা। তাই ভাইরাস অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা মার্কিনিদের নাকাল করে ফেলছে।
কলকাতার সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া বা নিউ জার্সির একটা কালোবাজারির অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছি। আগে যেখানে একটা মগের দাম ছিল মাত্র পাঁচ ডলার, সেটাই লকডাউনে ২০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। আগে যে শাকসবজি ইন্ডিয়ান স্টোরে ১০ থেকে ১২ ডলারে পাওয়া যাচ্ছিল, তাই এখন ২৫ থেকে ৩০ ডলার হয়ে গিয়েছে। আগে রান্নাঘরে ব্যবহার করা ছোট তোয়ালের রোল ১০টির দাম ছিল ১৬ ডলার। সেটাই এখন ২৮ ডলারে বিকোচ্ছে। মাংসের দোকানে প্রথম দিকে অনেকেই একসঙ্গে ২৫-৩০ পাউন্ড কিনে নিচ্ছিল। দিনকয়েক হল সেখানে এখন কড়াকড়ি করে দেওয়া হয়েছে। পরিবারপিছু ৯-১০ পাউন্ডের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতায় শুনলাম, জুনের ১০ তারিখ পর্যন্ত স্কুল ছুটি করে দিয়েছে। আমাদের এখানে সেপ্টেম্বরে স্কুল-কলেজ খুলবে। আর একটা কথা শুনছি, সরকারিভাবে এখানে যাদের মৃত্যু হচ্ছে, তা নাকি সব প্রকাশ করা হচ্ছে না।
আর্থিক পরিস্থিতি কতটা সংকটজনক তার একটা তথ্য দিই। ওল্ড ব্রিজ রেস্তরাঁয় একসঙ্গে ২৩০ জন বসতে পারে। ভারতীয় সোসাইটিতে চাহিদা ছিল এখানকার খাবারের। কিন্তু আর্থিক সংকট এমন জায়গায়, এই রেস্তরাঁয় লকডাউনের আগেরদিনও রমরম করে চলছিল। কিন্তু সেটা শুধু বন্ধ করে দেওয়া হল না, আগামী দিনে এই ব্যবসা আর করা যাবে না। এছাড়াও আইটি সেক্টরের কাজকর্মও জোর ধাক্কা খেয়েছে। এখন ভারতবাসীর মতো আমরাও অপেক্ষা করছি, ট্রাম্প প্রশাসন কী আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.