শঙ্কর ভট্টাচার্য, কাঠমান্ডু: মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহাল ওরফে প্রচণ্ডকে সরাসরি ফোন করে ‘বাম’ ঐক্যের আহ্বান জানালেন নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি। দু’জনের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে বলে খবর। হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ভোটে পিছিয়ে পড়ার পর বিরুদ্ধ ফ্রন্টের নেতাকে কেন ফোন করতে গেলেন তিনি। কী কথা হল? দু’জনেই বলছেন সৌজন্য। কিন্তু এই খবরে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর রাজনীতি প্রবল ঠাণ্ডাতেও উষ্ণ হতে শুরু করেছে। এর পরেই তড়িঘড়ি শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেরবাহাদুর দেউবা ডেকে পাঠান জোট সঙ্গী প্রচণ্ডকে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, কাঠমান্ডুর বালুওয়াটারে দুই নেতার মধ্যে কথা হয়। জোট বজায় রাখার অঙ্গীকার আদায় করে নেন দেউবা। তবে ওলি-প্রচণ্ড গোপন ফোনালাপই চাপ বাড়াচ্ছে ভারতের।
দ্বিতীয় খবরটি আরও বিস্ময়কর। প্রচণ্ডর দল নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদী কেন্দ্রের সদ্য নির্বাচিত সাংসদ, দলের মহাসচিব বর্ষমান পুন ওরফে অনন্ত হঠাৎই চিনে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। তাঁর নাকি শরীর খারাপ। তাই তড়িঘড়ি চিকিৎসা করাতে বেজিং ছুটছেন। কিন্তু যাবেন কেমন করে? কাঠমান্ডু-বেজিং বিমান পরিষেবা তো করোনা কাল থেকে বন্ধ। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত কার্গো বা পণ্য পরিবহনের বিমানেই যাচ্ছেন। অনন্ত কিন্তু গত বছর ঠিক এই নভেম্বর মাসেই চিনে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। তখন তাঁর বিলিরুবিন নাকি বেড়ে গিয়েছিল। ব্যাংককের হাসপাতাল থেকে সরাসরি বেজিং ছুটেছিলেন তিনি। এবার ফের ভোট মিটতেই চিন (China) যাত্রা। তিন নম্বর ঘটনা অবশ্য ভোটের ঠিক আগের। তখন প্রচার তুঙ্গে। দিনটা ছিল ১১ নভেম্বর। চিনের সাংস্কৃতিক এবং পর্যটন মন্ত্রকের ভাইস মিনিস্টার লি কুন কাঠমান্ডু এসেছিলেন। আর ভোট হয়েছে ২০ নভেম্বর। ভোটের আগে চিনা মন্ত্রীর আগমন নিয়ে খুব হইচই শুরু হয়। নেপালের বিদেশমন্ত্রক তাঁকে ভোটের মুখে আসতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু তিনি অনড়। বেজিংয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এটা নেহাতই ব্যক্তিগত সফর। নেপালের পুরাতত্ত্ব দফতরের মহাসচিব দামোদর গৌতম জানান, নেপালে ভূমিকম্পের পর যে সব ঐতিহাসিক ইমারত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা মেরামত করছে চিন। তা দেখতেই মন্ত্রীর সফর। নেপাল সরকারের আপত্তি, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশ উপেক্ষা করেই কাঠমান্ডু, ললিতপুর, ভক্তপুরে কয়েক দিন ধরে ঘুরেছিলেন তিনি। ভোট মেটার পরই তিনি ফিরে যান। এই তিন ঘটনা নিয়ে অঙ্ক মেলাতে বেশি বেগ পেতে হবে না নেপালের রাজনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞদের।
এক কথায় বলা যায় ‘খেলা শুরু’। ম্যাচ ক্রমশই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝে এবার নেমে পড়েছে চিন। নেপালের রাজনীতিতে ফের ‘ছক্কা পাঞ্জা’ শুরু হয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।আসলে ওলির আমলে নেপাল বিভিন্ন প্রশ্নে পুরোপুরি চিনের দিকে ঝুঁকেছিল। শোনা যায়, কাঠমান্ডুতে অবস্থিত চিনা রাষ্ট্রদূত হাউ ইয়ানকি নাকি সরাসরি দেশের নীতিতে নাক গলাতেন। তাঁর অবাধ গতিবিধি ছিল প্রধানমন্ত্রীর ঘরে। ঠিক ভোটের আগেই সেই মহিলাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই দেশের সংবাদ মাধ্যমে নিজের এক হাজার দিনের অভিজ্ঞতার কথা লিখে বেজিং ফিরেছেন তিনি।
ওলির আমলে ২০১৯ সালে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কাঠমান্ডু এসেছিলেন। তখনই চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ শামিল হয় নেপাল (Nepal)। গালওয়ান সংঘর্ষের সময়েই ওলি উত্তরাখণ্ডের কালাপানি, লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা নিজেদের বলে দাবি করেন। রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভাণ্ডারী চিন সফরে যান। চিনের উদ্যোগেই সেই সময় সব ক’টি বাম দল মিলে তৈরি হয়েছিল এনসিপি। মাওবাদীরাও ছিলেন সেই ঐক্যবদ্ধ দলে। দলীয় কর্মীদের জিনপিং-এর ‘চিন্তাধারা’ বোঝানোর জন্য চিনা সেনা পিএলএ প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। পরে আদালতের নির্দেশে সব বাম দলের এক হওয়া বন্ধ হয়। সেই জোটবদ্ধ প্রক্রিয়া বেআইনি ঘোষিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে আদালতের নির্দেশে দেউবা ক্ষমতায় আসেন ২০২১ সালে। রাজনৈতিক মহলের মতে, এখন আবার সেই পুরনো খেলাই শুরু করার চেষ্টায় বেজিং।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.