Advertisement
Advertisement

Breaking News

Padma Setu

প্রদীপের নিচে অন্ধকার! পদ্মা সেতুর সাফল্যের ‘ধাক্কায়’ রুটিরুজির দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ী ও হকাররা

নবনর্মিত সেতুই রাতারাতি গুরুত্বহীন করে দিয়েছে ফেরিঘাট সংলগ্ন দোকান বাজারগুলিকে!

Padma Setu casts gloom on traders near ferry ghats | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 29, 2022 5:53 pm
  • Updated:June 29, 2022 6:00 pm

সুকুমার সরকার, ঢাকা: প্রদীপের নিচেই অন্ধকার! পদ্মা সেতুর সাফল্যের ‘ধাক্কায়’ রুটিরুজির দুশ্চিন্তায় ভুগছেন ব্যবসায়ী ও হকারদের একাংশ। এক সময় যে ফেরিঘাটগুলি কোলাহলে মুখর ছিল, সেখানেই যেন আশ্চর্য নীরবতা। আসলে নবনর্মিত সেতুই রাতারাতি প্রায় গুরুত্বহীন করে দিয়েছে ফেরিঘাট সংলগ্ন দোকান বাজারগুলিকে।

শেখ হাসিনার হাত ধরে গত শনিবার স্বপ্নের পদ্মাসেতুর উদ্বোধন হয়। তারপর থেকেই  বাংলাদেশের (Bangladesh) কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ইদ আর স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মতোই আনন্দ বইছে। তাঁদের ৪/৫ ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হয়েছে। কাউকে পদ্মা পার হওয়ার জন্য আর বাড়তি সময় গুণতে হচ্ছে না। বাসে বা যে কোনও যানবাহনে করে সেতুতে উঠে মাত্র ৭ মিনিটেই পার হয়ে যাচ্ছেন পদ্মা। এই আনন্দের মধ্যেই কিছু মানুষ নিজের রুজিরুটি হারিয়ছেন। তাঁরা পদ্মাপাড়ের মাওয়া-জাজিরার বাসিন্দা। কাজ হারিয়ে পেশা বদলের দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকাররা। যদিও এটা আঁচ করে অনেকেই নতুন পেশা বেছে নিয়েছেন। পদ্মা সেতুর চালু হওয়ায় প্রকট প্রভাব পড়েছে দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল বিভাগের ঢাকায় যাওয়া-আসায় যাতায়াতকারী লঞ্চগুলোতে। সেতু চালুর আগে একেকটি লঞ্চে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ যাত্রী হতো। সেতু চালুর পর সেখানে ১০০ যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না।

Advertisement

[আরও পড়ুন: বাংলাদেশে কোনও ‘ভবিষ্যত নেই’, ইউরোপের শরণাগত অন্তত ২০ হাজার]

লঞ্চের যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চের যাত্রা আরামদায়ক বটে। কিন্তু কেবিন ও ডেকের ভাড়া বেশি। আবার সময়ও বেশি লাগে। ফলে তাঁরা টাকা ও সময় বাঁচাতে বাসে করে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করছেন। ঢাকা-বরিশাল নৌপথে কয়েকশো যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করতো। বরিশাল লঞ্চঘাটের টোল আদায়কারী সুমন গাজী বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে প্রতিদিন বেলা দু’টোর মধ্যে পাঁচশো যাত্রী ঘাটে টোল দিয়ে লঞ্চে উঠে বিছানা পেতে বসে থাকতেন। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চে যাত্রী নেই। ১০০ জনের বেশি যাত্রী হচ্ছে না। সেতু চালু হওয়ায় নদীপথের অনেক সময় কম লাগে সড়কপথে। তদুপরি লঞ্চডুবির সে ভয়ও নেই। বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া লঞ্চঘাটের টোল আদায়কারী রাজা পহলান বলেন, “এক সপ্তাহ আগেও এই ঘাট থেকে প্রায় আড়াইশো যাত্রী ঢাকা যেতেন। গতকাল এ ঘাট দিয়ে মাত্র ৮০ জন যাত্রী ঢাকায় গিয়েছেন।”

Advertisement

মাওয়া-জাজিরায় পদ্মার ঘাটেই ছিলেন কয়েকশো হকার। দিনরাত লঞ্চ, ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করতেন ঝালমুড়ি, ছোলা, সেদ্ধ ডিম, সিঙ্গারা, নারকেল চিড়া, শসা, দই-সহ নানা রকম মুখরোচক খাবার। ছিলেন চা, পান-সিগারেট বিক্রেতারা। প্রতিটি লঞ্চে তিন থেকে চারজন করে নানান জিনিস নিয়ে উঠতেন হকাররা। এছাড়া লঞ্চে ছিল হোটেল-রেস্তরাঁ। শুধু পদ্মাপাড়ের মানুষই নয়, অন্য এলাকার খেটে খাওয়া মানুষেরাও ঘাটে হকারি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। এদের মধ্যে মুখরোচক খাবার বিক্রেতাদের সংখ্যাই হবে কমপক্ষে ৫০০ জন। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই নৌযানে ঘুরে ঘুরে নানা খাবার-দাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন তাঁরা। পদ্মাসেতু হওয়ার আগে মাওয়া নৌরুটে ৮৭ টি লঞ্চ, দেড়শতাধিক স্পিডবোট, ৫৭ টি ফেরি চলাচল করেছে। এ সকল নৌযানে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী নিয়মিত পার হয়েছেন। এই যাত্রীদের ওপর নির্ভর করেই হকার শ্রেণির ব্যবসা।

মাওয়ার পদ্মাপারের আরিফ জানান, তাঁরা লঞ্চে হকারি করেছেন। সেতু হবে বলে তাঁদের থেকে সরকার জমি অধিগ্রহণ করে। অবশ্য কুমারভোগ পুনর্বাসন সাইটে তাঁদের প্লট দেওয়া হয়েছে৷ তিনি জানিয়েছেন, ছেড়ে আসা সেই বাড়িতেই এখন গড়ে উঠেছে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজা৷ এই সেতুর কারণে ঘর-বাড়ি হারালেও তাতে আফসোস নেই তাঁর৷ বরং তিনি বলছেন, ‘এখন বরং জীবন আরও সহজ হয়েছে৷ সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে৷” পুরনো বাড়ির স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “তখন একটু বন্যা হলেই বাড়িতে জল উঠতো৷ এখন আর সেটা হয় না৷ এলাকার যাতায়াত, জল সরবরাহ, ড্রেনেজ সিস্টেম ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে৷ পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ রজব আলী বলেছেন, পদ্মা সেতুর কারণে ২০ হাজার ৭৫৫টি পরিবারের থেকে জমি কেনা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৭টি পুনর্বাসন সাইট গড়ে তোলা হয়েছে৷ এসব সাইটে প্লট রয়েছে ৩ হাজার ১১টি৷

পদ্মা সেতু (Padma Setu) উদ্বোধনের দু’দিন বাদে ঘাটে কথা হয়- ঝালমুড়ি বিক্রেতা হারুন ও ডিমসিদ্ধ বিক্রেতা মামুনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, সেতু চালু হলে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার শঙ্কা থেকে অন্য পেশায় যাবার কথা ভাবছিলেন। এখন তাঁরা হকারি ছেড়ে বাড়ির সামনে চা, পান-সিগারেটের দোকান দিয়েছেন। খদ্দের এখন গ্রামের লোকেরাই। স্পিডবোট চালক আবুল মিয়াঁ বলেন, “আমি পদ্মাপাড়ের ছেলে। কিছু জায়গা-জমি আছে। আর কিছু বরগা নিয়ে বাপ-দাদার পেশা চাষবাস করব।” নারকেল-চিড়ে বিক্রেতা বাবু জানান, তিনি ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারখানা বা অন্য কাজ খুঁজে নেবেন।

উল্লেখ্য, ১৯৮৭ সালে বিক্রমপুরের (মুন্সিগঞ্জ) মাওয়া এবং মাদারীপুর জেলার মাঝিরকান্দি ও চরজানাজাত ফেরি পরিষেবা চালু হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু হলে মাওয়া থেকে শিমুলিয়ায় ঘাট সরিয়ে আনা হয় ২০১৪ সালে। এরপর শিমুলিয়া-বাংলাবাজার, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ও মাঝিরকান্দি ঘাটে লঞ্চ, ফেরি স্পিডবোট চলাচল করেছে। কর্মহীন হওয়ার শঙ্কার মধ্যেও মাওয়া ও শিমুলিয়া ঘাটের হোটেল-রেস্তরাঁর ইলিশের ব্যবসায়ীরা আরও রমরমা হবে বলে আশায় আছেন। তাঁরা বলেন, সেতু চালু হলে সবখানে ঘাট মরে যায়, কিন্তু এখানে উলটো চিত্র দেখা যাবে। যেহেতু সময় কম লাগবে, তাই টাটকা ইলিশের স্বাদ নিতে ঘাটে নামার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। পদ্মা সেতু ঘিরে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকার কারণেও মাওয়া-শিমুলিয়ায় পদ্মা তীরের রোস্তরাঁয় ইলিশের চাহিদা বাড়ছে অনেক দিন ধরে। শুধু ইলিশেরই অর্ধশত রেস্তরাঁ গড়ে উঠেছে মাওয়া-শিমুলিয়া ঘাটে। ‘রূপসী বাংলা’, ‘রূপালি ইলিশ’, ‘শখের হাঁড়ি’, ‘কুটুমবাড়ি’, ‘শখের ইলিশ’, ‘ইলিশ আড্ডা’ ‘ইলিশ ভোজ’-সহ আরও নানা রকম বাহারি নামের এসব রেস্তরাঁ খোলা থাকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। শিমুলিয়ার ইলিশ রেস্তোরাঁর সামনে ইলিশ মাছের টুকরো সাজানো থাকে। সঙ্গে ভাত, ভর্তা, ভাজি-সহ অন্যান্য খাবার নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কর্মচারীরা। ক্রেতা মাছ দেখে অর্ডার করার পর টেবিলে ইলিশ ভাজা পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। সহজে নজর কাড়ে শিমুলিয়ার ইলিশ আকৃতির ‘হিলশা প্রজেক্ট’ নামের রেস্তরাঁয়।

শিমুলিয়ার ইলিশ রেস্তোরাঁ মালিকদের সংগঠন ‘ইলিশ রেস্তোরাঁ হাটের’ সভাপতি মুরাদ খান বলেন, “সেতু চালু হলে ঘাটে লাখো লোক আসবেন, যাদের অধিকাংশই ইলিশের স্বাদ নিয়ে ফিরবেন। সেতুকে ঘিরে পদ্মার পাড়ে একাধিক গ্রামীণ বাজার তৈরি হওয়া-সহ বাজারের পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মার পাড়ের নদী শাসন বাঁধ-সহ সেতু এলাকার অনেকটাই পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে। বিকেলের দিকে অসংখ্য মানুষ আসেন ঘুরতে। সেক্ষেত্রে জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু না কিছুর ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস।

[আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পরিবহণ বিপ্লব! এক বছরের মধ্যেই পদ্মা সেতুতে চলবে ট্রেন]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ