দেবব্রত মণ্ডল, দক্ষিণ ২৪ পরগনা: নদীর মাছই ভরসা বাদা বনের বাসিন্দাদের। তাই কুমির, কামটের সঙ্গেই মানিয়ে নিয়েই চলে মাছ ধরার পর্ব। তাই জন্ম থেকেই এখানকার বাসিন্দাদের কর্ম সংস্থানও ঠিক হয়ে যায়। সুন্দরবনের বাসিন্দাদের তো শিরে সংক্রান্তি অবস্থা। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। তবুও তার মধ্যেই নদীতে মাছ ধরে চলে জীবিকা নির্বাহ। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আতঙ্ক সঙ্গে নিয়েই সোমবার মাছ ধরতে গিয়েছিলেন তিন মৎস্যজীবী। বুধবার সকালে তীরের কাছাকাছি মাছ না মেলায় চলছিল কাঁকড়া ধরার কাজ। আচমকাই ঝপ করে শব্দ, দুলে উঠল ডিঙি। তিনজনের একসঙ্গী ততক্ষণে দক্ষিণ রায়ের থাবায়। আক্রান্ত মৎস্যজীবীর নাম মধুসূদন মণ্ডল। ক্ষতবিক্ষত সঙ্গীকে বাঁচিয়ে আনার তাড়ণায় ততক্ষণে মানুষখেকো বাঘের সঙ্গে অসম লড়াইতে নেমে পড়েছেন মধুসূদনের দুই সঙ্গী সুপদ বরকন্দাজ ও বিমল মণ্ডল। হাতের কাছে থাকা লাঠি নিয়েই চলে লড়াই। একটা সময় রণে ভঙ্গ দেয় বাঘ। ক্ষতবিক্ষত মৎস্যজীবীকে ফেলে পায়েপায়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যায়। তড়িঘড়ি রক্তাক্ত সঙ্গীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেও লাভ কিছু হয়নি। বাদাবনের মানুষের চিরন্তন চোখের জলকে সত্যি করে মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেন মৎস্যজীবী মধুসূদন মণ্ডল।
মধুসূদনবাবুর মাছ ধরতে যাওয়ার শেষযাত্রা কেমন ছিল একবার ফিরে দেখা যাক। কোজাগরী পূর্ণিমা। নদীতে জোয়ারের জল ঢুকছে কুলকুল শব্দে। ছোট আঁকা বাঁকা নদীতে তখন লাফালাফি করছে গুলে, চিংড়ি পারসের মতো মাছেরা। বড় বড় সমুদ্র কাঁকড়াদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে ঝোপে ঝাড়ে। তাই দেখে নদীর মোহনা থেকে খাঁড়ির মধ্যে এসে নৌকার বৈঠা নামিয়ে নেন মৎস্যজীবী। পরিস্থিতি অনুকূল বুঝে পচা মাছ দিয়ে বানানো থোপা সবে জলে ফেলা শুরু হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁকড়ার টান ও শুরু হয়েছে থোপার দড়িতে। তাই দেখে নিজেদের অবস্থান ঠিক করলেন তিন মৎস্যজীবী। চলল কাঁকড়া ধরার পর পালা। ঘণ্টাটাকও কাটেনি, আচমকাই ঝপাং শব্দে দুলে উঠলো হাত চল্লিশের ডিঙি নৌকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হেতাল ঝোঁপের মধ্যে দক্ষিণ রায়। মুখে মধুসূদনের দেহ। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। বাঘের থাবায় ততক্ষণে ক্ষতবিক্ষত মধুসূদন। নোনা কাদা মাটিতে ছড়িয়ে আছে মধুসূদনের কাঁচা রক্ত। সঙ্গীর এই মৃত্যুযন্ত্রণা দেখে আর ঠিক থাকতে পারেননি সঙ্গী সুপদ বরকন্দাজ ও বিমল মণ্ডল। মৃত সঙ্গীর দেহ নিয়ে গোসাবার ঘাটে এসে একথাই জানাচ্ছিলেন সুপদ। আতঙ্ক তখন ও তাড়া করে ফিরছে তাঁদের। মাঝে মধ্যে শিউরে উঠছেন দুই সঙ্গী।
[স্বামীর সঙ্গে মামিশাশুড়ির বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, পুলিশের দ্বারস্থ গৃহবধূ]
ঘটনাটি ঘটেছে সুন্দরবন ব্যাঘ্রপ্রকল্পের পীরখালির জঙ্গল সংলগ্ন লেবুখালি নদীতে। সোমবার গোসাবার সত্যনারায়ণপুর গ্রাম থেকে কাঁকড়া ধরতে যান তিন মৎস্যজীবী। বুধবার সকালে মৎস্যজীবীদের দলটি কাঁকড়া ধরায় যখন ব্যস্ত ছিল তখনিই বাঘ লাফ মারে মধুসূদন মণ্ডলের ঘাড়ে। বছর তিপান্ন বয়স। অন্য দুই সঙ্গী তখন নৌকার মাঝেই বসে কাঁকড়া সংগ্রহ করছিলেন। তখনই বুঝতে পারেন বাঘের মুখে পড়েছেন। হাতে কাছে থাকা লাঠি নিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করেন দু’জনে। বাঘের মুখ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন মধুসূদনকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাড়িয়ে আনলে ও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। নৌকায় চাপিয়ে আশঙ্কা জনক অবস্থায় গোসাবা হাসপাতালে আনার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। এবিষয়ে সঙ্গী সুপদ বরকন্দাজ বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঘের মুখ থেকে ছাড়িয়ে আনলেও বাঁচাতে পারলাম না। এটাই আক্ষেপ থেকে গেল।’
[মাকে মিষ্টি খাওয়ানোর ‘অপরাধ’, বৃদ্ধ বাবাকে বেধড়ক মারধর ছেলের]
গ্রামে ফিরে এসে মৎস্যজীবীদের দলটি ব্যাঘ্রপ্রকল্পের অফিসে অভিযোগ দায়ের করেছে। দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে:s গোসাবা থানার পুলিশ। গোসাবা হাসপাতাল সূত্রে খবর, বাঘের আঘাতে মধুসূদনবাবুর দেহে একাধিক ক্ষত হয়েছে। সেই ক্ষত থেকে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণেই মৃত্যু।