Advertisement
Advertisement

Breaking News

DA

কিছু ‘মহার্ঘ’ প্রশ্ন

এক ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসছে এই আন্দোলনকে সংহতি জানাতে- তা কি অস্বীকার করা যায়?

Agenda behind DA protest in Bengal | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 9, 2023 1:06 pm
  • Updated:March 9, 2023 1:06 pm

মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েও কিছু কথা বলতে হয়। ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টায় যে এক ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসছে এই আন্দোলনকে সংহতি জানাতে- তা কি অস্বীকার করা যায়? কলমে সেনগুপ্ত

বাংলার সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘটের পথে। ১০ মার্চ, তাঁরা ধর্মঘটে শামিল হবেন। প্রচুর মানুষ এই দাবিতে সমবেত হচ্ছেন, ধর্মতলার শহিদ মিনারের পাদদেশে। কিছু যুবক অনশন করছেন। কিছু মানুষ ধরনা-মঞ্চে উপস্থিত হচ্ছেন রোজ, আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে। ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানানো তরুণ কর্মচারীরা ধরনা-মঞ্চে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। বেশ কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকাও আছেন। আন্দোলনের মেজাজে কোনও খামতি নেই। সরকারের কাছে নোটিস পাঠানো হয়ে গিয়েছে যে, রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘটে যাচ্ছেন। আইনজীবীরা ধরনা-মঞ্চে এসে আশ্বাস দিচ্ছেন, কোনও চিন্তা নেই। সরকার এইভাবে চাকরিতে ছেদ আনার কথা বললে, তঁারা নাকি ‘আদালতে বিষয়টা বুঝে নেবেন’! নিজে একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে, এই ধরনের আন্দোলন দেখে উৎসাহ জাগে। ন্যায্য মহার্ঘ ভাতা তো কারও দয়ার দান নয়, এ তো অধিকার। তা থেকে কেন সরকার তার কর্মচারীদের বঞ্চিত করছে?

Advertisement

সরকারের সপক্ষে কিছু যুক্তি অবশ্যই আছে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রচুর টাকা বকেয়া রেখেছে। তাই এই মুহূর্তে এই মহার্ঘ ভাতা দিতে তারা অপারগ। নরমে-গরমে বলা হচ্ছে, এই ধর্মঘট অনৈতিক। বাংলায় যে ধর্মঘটের সংস্কৃতি ছিল, বর্তমান সরকার তা থেকে বের করে আনতে চায় রাজ‌্যকে। তাই এই ধর্মঘটে যঁারা অংশ নেবেন, তঁাদের চাকরি-জীবন থেকে একটি দিন বাদ যাবে। যদিও বাংলা বহুদিন এই ধরনের ধর্মঘট দেখেনি, কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা কোনও দিন নিজেদের দাবিতে ধর্মঘট করেননি, সে-কথাও সত্যি নয়।

Advertisement

১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। ‘রাষ্ট্রপতি শাসন’ জারি হয় সমগ্র দেশে। তারপর থেকে মহার্ঘ ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলন শুরু করেন। তখন সিদ্ধান্ত হয়, মহার্ঘ ভাতার বদলে ৮ টাকা করে ‘ডোজ’ (DOSE) যুক্ত করে দেওয়া হবে মূল বেতনের সঙ্গে। সরকারি কর্মচারীরা এই নিয়ম মানতে পারেননি। তাঁরা ওই বছরের ২৬-২৮ আগস্ট ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয় কর্মচারীদের উপর। প্রচুর মানুষের চাকরি যায়। ১৯৭৭ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পরে সমস্ত কর্মচারীকে ফের কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

[আরও পড়ুন: কীভাবে শুরু নারী দিবসের? নেপথ্যে ছিলেন কারা? ফিরে দেখা এক শতাব্দী]

তবে যাঁরা মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাঁদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েও কিছু কথা বলতে হয়। ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টায় যে এক ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আসছে এই আন্দোলনকে সংহতি জানাতে- তা কি অস্বীকার করা যায়? এখন যাঁরা মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাঁদের দাবি অত্যন্ত ন্যায়সংগত। কিন্তু তা-ও কিছু প্রশ্ন এসেই যায়।

যাঁরা এই আন্দোলনে সংহতি জানাতে আসছেন, তাঁদের অনেকেই এখনকার বাংলার প্রধান বিরোধী দলের নেতা এবং কর্মী। কেন্দ্রে তাঁদের যে সরকার আছে, তা কি আদৌ ধর্মঘটের রাজনীতিকে সমর্থন করে? সরকারি কর্মী নিয়োগ নিয়ে তাদের নীতি কী? সেই সরকার কি বলে না, সমস্ত কিছু বেসরকারি হাতে চলে যাক? তারা কি দেশের সরকারি রেল থেকে বিমা পরিষেবা বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর নয়? রেলের মতো পরিষেবা কি তারা শিল্পপতিদের হাতে বন্ধক দেয়নি? রেলের নিয়োগ এখন কে করে? দেশের সমুদ্র বন্দরগুলিকে, বিমানবন্দরকে কি তারা বেচে দেয়নি কেন্দ্র-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের কাছে? তাদের নেতৃত্বের মুখে এখন সরকারি কর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা কি মানায়? তারা কি ‘আশা’-কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি দিতে পারবে? মিড-ডে মিলের কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা কেন থাকবে না, তাদের যদি এই প্রশ্ন করা হয়, কী উত্তর দেবে?

হয়তো অনেক আন্দোলনকারী বলবেন, যে কোনও মানুষ, যে কোনও আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে পারেন, তাতে কি বিরোধিতা করা যায়? হয়তো তাঁরা ঠিকই বলছেন। কিন্তু তা-ও সবার কি হক আছে, এই ধরনের আন্দোলনে সংহতি জানানোর? যে সরকার সারাক্ষণ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রক্রিয়ার পক্ষে, এমনকী, সেনাবাহিনীতেও চুক্তিভিত্তিক ‘অগ্নিবীর’ নিয়োগকে মান্যতা দেয়, তারা কী করে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার দাবিকে সমর্থন করবে? তারা রাজ্যে ক্ষমতায় এলে কি সমস্ত সরকারি কর্মচারীকে বকেয়া মহার্ঘ ভাতা দিতে পারবে? পারবে না, বা পারলেও দেবে না। তখন তারা যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, বা স্বশাসিত সংস্থাগুলির কর্মীদের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করবে না, তা-ও কি নিশ্চিত করে বলা যায়? যারা নতুন ‘শ্রম কোড বিল’ এনে শ্রমিক কর্মচারীদের ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তারা যদি কখনও বাংলায় ক্ষমতায় আসে, তাহলে এখন যাঁদের চাকরি-জীবনে ছেদ পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ঘনাচ্ছে, তাঁদের চাকরি কি সসম্মানে ফিরিয়ে দেবে? তারা ‘আশা’ কিংবা ‘অঙ্গনওয়াড়ি’ কর্মীদের স্থায়ী চাকরির নিশ্চয়তা দেবে, হলফ করে বলা যায়?

যাঁদের কম আছে, তাঁদের কাছে যাতে সরকারি সুবিধা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা এখন রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্য। অবশ্যই ভাল অভিপ্রায়। তবে সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য ন্যায্য মহার্ঘ ভাতা থেকে বঞ্চিত করা কেন, তা-ও বিবেচনা করে দেখতে অনুরোধ করি? এবং যঁারা বকেয়া মহার্ঘ ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাঁদের অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য, যেভাবে তাঁরা বিভিন্ন প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসছেন, তার জন্য তাঁদের অবশ্যই অভিনন্দন প্রাপ্য, কিন্তু যাঁরা এই আন্দোলনে এসে রাজ‌্য সরকারকে নানা প্রশ্নে তুলোধোনা করছেন, তাঁদের আচরণ বা বক্তব্য কি সমালোচনার ঊর্ধ্বে? যাঁরা ধরনা দিচ্ছেন নিজেদের দাবি নিয়ে, তাঁরা যদি পাশাপাশি সমস্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করতেন, স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ হোক- এই দাবি তুলতেন- তা কি বেশি ভাল হত না?

 

(মতামত নিজস্ব)
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার
[email protected]

[আরও পড়ুন: শান্তিনিকেতনে কি চরিতার্থ হচ্ছে গোপন অ্যাজেন্ডা?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ