Advertisement
Advertisement
Rahul Gandhi

তফাত শুধু রাজনীতির

‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কংগ্রেস ও রাহুলকে একটা সমীহ করার মতো জায়গায় তুলে দিয়েছিল।

Has Rahul Gandhi provided ammo to BJP with Cambridge speech | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 16, 2023 11:22 am
  • Updated:March 16, 2023 11:22 am

‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কংগ্রেস ও রাহুলকে একটা সমীহ করার মতো জায়গায় তুলে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কেমব্রিজে চিরাচরিত ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ্‌ম’-এর কথা না-শুনিয়ে তিনি কি বিকল্প রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা কিংবা বহুত্ববাদিতার প্রয়োজনীয়তার কথা নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন না? কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

Advertisement

রাহুল গান্ধী হয়তো অজান্তেই বিজেপির হাতে মোক্ষম এক অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, চলতি বছর ছয় রাজ্যের বিধানসভা ভোটে এই অস্ত্র-ই হতে চলেছে কংগ্রেস-বধে বিজেপি-র শক্তিশেল। সেই ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যেই দিয়েছেন। লন্ডনের মাটি থেকে ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন তোলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দেশবাসীকে এদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকার নিদান দিয়েছেন।

Advertisement

‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ কংগ্রেস ও রাহুলকে অনেক বছর পর একটা সমীহ করার মতো জায়গায় তুলে দিয়েছিল। কংগ্রেস-কর্মী ও সমর্থকদের কিছুটা চনমনে করেছিল। দশ বছর পর কর্মী-সমর্থকরা একটা আন্দোলনের শরিক হয়েছিল। হতাশার গহ্বর থেকে বের করে তাদের আলোর ঝলকানি দেখিয়েছিল হিমাচল প্রদেশের নির্বাচনী ফল। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা তা অনুধাবন করে রায়পুর সম্মেলন থেকে পরবর্তী ভারত জোড়ো যাত্রা-র কথাও ঘোষণা করেন। কিন্তু রাহুলের বিলেত-সফর বিজেপির জড়তা কাটিয়ে তাদের নতুন করে চাগিয়ে দিয়েছে। ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা’ অস্ত্রে শান দেওয়া শুরু হয়েছে। যেভাবে তারা ঘুঁটি সাজাচ্ছে, তাতে রাহুলের লোকসভার সদস্য পদ কেড়ে নেওয়া অসম্ভব নয়।

[আরও পড়ুন: মার্কিন ব্যাংক সংকটের প্রকোপ কি পড়বে ভারতে?]

‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ মধ্যভারতে প্রবেশের পর রাহুলকে নিয়ে কটাক্ষ-তামাশা বিজেপি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত দেদার ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেছে। কিন্তু নিজেরাই যখন বোঝে, এই যাত্রা সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে, বিজেপি ও মোদিকে ভোট দিয়েও নানা কারণে অসন্তুষ্ট মানুষ রাহুলের যাত্রা ও কথা অর্থবহ মনে করছে, তখন তারা চুপ করে যায়। ভাষা ও আচরণে সংযত হয়। যে-সময় তারা কংগ্রেসকে নিয়ে কিছুটা অন্যরকম ভাবনাচিন্তা শুরু করছিল, সে-সময়ই রাহুল ব্রিটেনে গেলেন এবং বিজেপির হাতে তুলে দিলেন অযাচিত এক অস্ত্র। সেই অস্ত্র-প্রয়োগে বিজেপি এখন সরাসরি রাহুল গান্ধীকে ‘ভারত-বিরোধী বিদেশি চক্রান্তর অংশীদার’ করে তুলেছে। এই কাজটা তারা খুব ভাল পারে। সবার চেয়ে বেশি পারদর্শী। সমবেত প্রচারে কংগ্রেস ও রাহুলকে তারা ‘খলনায়ক’ করে তুলতে চাইছে। রাহুলের বোঝা উচিত ছিল, বিজেপিকে তাদের চেনা মাঠে হারানো কঠিন-ই শুধু নয়, এককথায় অসম্ভব!

প্রধানমন্ত্রী নিজেই এখন সপ্তমে সুর তুলে বলতে শুরু করেছেন, বিদেশে দাঁড়িয়ে দেশের উঁচু মাথা রাহুল হেঁট করে দিয়েছেন। দেশের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সম্মান ধুলোয় মিশিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মোকাবিলায় পশ্চিমি দুনিয়ার হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। বুঝিয়েছেন, মানুষ যেন এই ‘দেশদ্রোহী’দের চিনে রাখে।

বিজেপির এই প্রচারে কতটা দুধ ও কতটা জল- তা মোটামুটি সবার জানা। কিন্তু রাজনীতি কখনও যুক্তি মেনে চলে না। এটা যেমন সত্যি, তেমন এটাও সত্যি যে, সবাই যখন সবদিক থেকে ‘কেষ্টা ব্যাটাই চোর’ বলে কাড়া-নাকাড়া বাজায়, জনতা তখন ভাবে- ওটাই ঠিক। বোফর্স, টু-জি, কয়লা নিয়ে এমনই হয়েছিল। আদানি, বিবিসি-র মোকাবিলাতেও তেমনই হচ্ছে। এই ধরনের খেলায় বিজেপির ধারে-কাছে কেউ নেই। রাহুলকে নতুন করে তারা ‘ভিলেন অফ দ্য পিস’ বানাতে চাইছে। রাহুলও অজান্তে সেই সুযোগ তাদের হাতে তুলে দিলেন।

‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ থেকে শুরু করে রাহুল ইদানীং যে-যে বিষয়ে মোদি সরকারের সমালোচনা করে চলেছেন, ব্রিটেনের বিভিন্ন আসরেও তিনি তার-ই পুনরাবৃত্তি করেছেন। যেমন, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। সংসদে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। গণতন্ত্রর নামে স্বৈরতন্ত্র চলছে। গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান আরএসএসের দখলে চলে গিয়েছে। মিডিয়া বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে বেছে-বেছে বিরোধীদের পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ্‌ম’ সবকিছু গ্রাস করেছে। অর্থনীতি বিপন্ন। বেকারত্বর তীব্র জ্বালা সমাজের সর্বত্র। সেই সমাজ নানাভাবে বিভাজিত ইত্যাদি।

বারবার বলা এসব কথা না-শুনিয়ে রাহুল কি বিকল্প রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা কিংবা বহুত্ববাদিতার প্রয়োজনীয়তার কথা নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন না? কেমব্রিজ না-বেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে যুব সম্প্রদায়ের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে পারতেন না? এই সময়টায়, যখন, পরবর্তী ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরু হতে বেশ কিছু সময় বাকি!

প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক, কারণ, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র সাফল্যের রেশ ধরে রাখতে গত দেড় মাসে রাহুল কিছুই প্রায় করেননি। তিন-তিনটে রাজ্যে বিধানসভার ভোট হয়ে গেল। রাহুল কী করলেন, যাতে তাঁর তাগিদের প্রমাণ মেলে? ত্রিপুরায় গেলেন না। নাগাল্যান্ডেও নয়। মেঘালয় গেলেন বুড়ি ছোঁয়ার মতো। একদিনের জন্য। অথচ, প্রধানমন্ত্রী হাজার কাজের মধ্যেও সময় বের করে তিন রাজ্যে গেলেন। একাধিকবার। মানুষ যখন দু’জনের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তখনই ‘সিরিয়াসনেস’ প্রশ্নটির উদয় হয়। আর, সেখানে বলে-বলে গোল দিয়ে যাচ্ছেন মোদি। এত সমালোচনার পরও জনসমীক্ষায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ তাঁকে এমনিই-এমনিই পছন্দ করছে না!

রাজনৈতিক মানসিকতার ফারাক কোথায় বিজেপি সেটাও আরও একবার দারুণভাবে বুঝিয়ে দিল। রাহুল যখন বিজেপি-বিরোধী দলের মধ্যে খাঁটি-ভেজালের পার্থক্য খুঁজতে ব্যস্ত, মমতা-কেজরিওয়াল, কেসিআর-কুমারস্বামীদের বিজেপি বিরোধিতায় খাদ কতটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, মোদি তখন বাস্তবোচিত রাজনীতির আবশ্যিকতার (বিসমার্কীয় দর্শনে ‘রিয়‌্যালপলিটিক’) পরিচয় রেখে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তিন রাজ্যেই ক্ষমতার শরিক হয়ে রইলেন। শত্রুতা ভুলে সাংমার হাতে হাত মিলিয়ে মেঘালয়ে ফের ঘাঁটি গাড়লেন। ত্রিপুরা রাজ পরিবারের প্রদ্যোত বিক্রম মাণিক্য দেব বর্মন ছিলেন কংগ্রেসের ঘরের ছেলে। রাহুলের বন্ধু। ভোটের আগে তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য রাহুল কুটোটি পর্যন্ত নাড়লেন না। অথচ ফলপ্রকাশের পর, কালক্ষেপ না করে বিজেপি তাঁকে টেনে নিল।

কংগ্রেসকে প্রান্তেবাসী করে বিজেপি আজ এমনিই-এমনিই একমাত্র সর্বভারতীয় দল হয়নি।
বলতে দ্বিধা নেই, ভারত জোড়ো যাত্রার সুফল রাহুল হেলায় হারাচ্ছেন। যে একাগ্রতা, জেদ ও ধৈর্য‌র প্রমাণ পাঁচমাস ধরে দেখালেন, কষ্ট করলেন, অর্জনও করলেন অনেক কিছুই, দেড় মাসের বিরতি, ঢিলেমি, নির্বাচনী প্রচারে অনাগ্রহ তাতে জল ঢালছে। বাড়তি বিতর্ক সৃষ্টি হল বিদেশ সফর নিয়ে। সফর-শেষে সবে দেশে ফিরেছেন তিনি। আর এই অবসরে বিজেপি উঠে-পড়ে লেগেছে তাঁকে আরও হেয় ও ছোট করতে।

[আরও পড়ুন: সেঞ্চুরির খরা কাটল বিরাটের, সহায় নিম করোলি বাবার আশীর্বাদ? কে এই ধর্মগুরু?]

স্পষ্টত, বিজেপি চাইছে রাহুল-সহ কংগ্রেসকে অন্যরকম চাপে রাখতে। লোকসভার অধিকার-ভঙ্গ কমিটি রাহুলের সদস্য পদ খারিজের বিষয়টি বিবেচনা করছে। যে-কমিটির চেয়ারম্যান বিজেপি, শাস্তির প্রস্তাবক বিজেপি, অধিকাংশ সদস্য বিজেপির, সংসদের দুই কক্ষের অধ্যক্ষরাও যখন নিরপেক্ষতার নামাবলি গায়ে চাপানোর প্রয়োজন বোধ করেন না, তখন রাহুলের সদস্যপদ খারিজ একমুহূর্তে হতেই পারে। সেই উদাহরণও কংগ্রেসের তৈরি করে দেওয়া। ‘জরুরি অবস্থা’-র সময় উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত জন সংঘর প্রার্থী সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর সদস্য পদ ১৯৭৬ সালে খারিজ করা হয়েছিল দেশের সম্মানহানির অপরাধে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অপমান-অসম্মান করার অপরাধে। বিদেশে থেকে স্বামী তা করেছিলেন। বিজেপি সেই রাস্তায় হাঁটার বোকামি হয়তো করবে না। তবে দেশ ও প্রধানমন্ত্রীর সম্মানহানি ঘটানোর অপরাধের তুলোধোনা করে ‘দেশপ্রেম’-এর নতুন সংজ্ঞা তৈরির কাজে তারা নেমে পড়েছে। পাশার দান উল্টে বিজেপি এখন আক্রমণাত্মক, আর কংগ্রেস ব্যস্ত রক্ষণে!

([email protected])

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ