সুতীর্থ চক্রবর্তী: সব রাজনৈতিক দলই ভোটের আগে তাদের ইস্তেহার প্রকাশ করে। ইস্তেহার প্রকাশ করার ব্যাপারটি আমাদের গণতন্ত্রে একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইস্তেহারে যা যা লেখা হয়, তা যদি ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছরে কোনও দল রূপায়িত করতে পারে, তাহলে দেশের অনেক মৌলিক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে এমনটা ঘটে না। ১৯৫২ সাল থেকে আমাদের দেশে নির্বাচন হয়ে আসছে। দেশে দুই স্তরে নির্বাচন হয়। একটা সাধারণ নির্বাচন যেখানে দেশের সরকার গঠন হয়৷ আবার প্রতিটি রাজ্যের আলাদা নির্বাচন রাজ্য সরকার গঠনের জন্য। ইস্তেহার কিন্তু সব ভোটের ক্ষেত্রেই থাকে। এমনকী, এখন পুর ও পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইস্তেহার প্রকাশ করে। এই সমস্ত ইস্তেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির যোগফল নিলে দেখা যাবে যে সেগুলি রূপায়ণ করা একরকম অসম্ভব ব্যাপার। যে কোনও প্রকল্প রূপায়ণ করতে গেলে সরকারি অর্থের প্রয়োজন হয়। ইস্তাহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রূপায়ণ করতে গেলে সরকারের কোষাগার থেকে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হবে, সেই পরিমাণ অর্থ কোনও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হাতে থাকে না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তবুও কেন ইস্তেহারে মানুষকে গোলাপি স্বপ্ন দেখানো হয়? ভোটের আগে ইস্তাহার প্রকাশ না করতে পারলে রাজনৈতিক দলগুলির যেন প্রচার শুরু হয় না। ইস্তেহার প্রকাশ অনুষ্ঠান ভোটের প্রচারের একটা অন্যতম হাতিয়ার। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন নয় দফায় হয়েছিল। প্রথম দফার ভোটের দিন বিজেপি তাদের ইস্তেহার প্রকাশ করেছিল। এই নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানায় কংগ্রেস। সেই কারণে এই বছর নির্বাচন কমিশন আগাম ঘোষণা করে দিয়েছিল যে, ইস্তেহার ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে কোনওভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। তাই দেখা গেল প্রথম পর্বের ভোটের তিন দিন অর্থাৎ ৭২ ঘণ্টা আগে বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করল। নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশের ক্ষেত্রে তৃণমূল অবশ্যই সবার আগে। ২৭ মার্চ সব দলের আগে তৃণমূলের ইস্তেহার প্রকাশ হয়েছে। যে দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই, তারাও তাদের ইস্তেহার প্রকাশ করে। যেমন সিপিআই-সিপিএমের রাজনৈতিক অবস্থা এখন খুব খারাপ। এ রাজ্যে এবার তারা হয়তো একটি আসনও পাওয়ার জায়গায় নেই। দিল্লিতেও তাদের ক্ষমতার কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তারাও ঘটা করে তাদের ইস্তেহার প্রকাশ করেছে। এইরকম আরও ছোট ছোট কয়েকটি দল তাদের ইস্তেহার প্রকাশ করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে ইস্তেহার রচনা করা রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক কর্মসূচির একটি অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। যদিও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে যা লেখা হয়ে থাকে, তা সাধারণ ভোটারদের কাছে ভোটের আগে পৌঁছয় না।
আমাদের রাজ্যে ইস্তেহার-সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে দেশের অন্যান্য প্রান্তের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয়। ভোটের প্রচারে এসে বহু রাজনৈতিক দলকে দেখা যায় বাড়িতে বাড়িতে ইস্তেহার পৌঁছে দিতে। বাড়িতে বাড়িতে ইস্তাহার পৌঁছলেও সেটা ভোটাররা আদৌ উলটেপালটে দেখে কি না, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। যারা ইস্তাহার পড়ে, তারাও সেটা এই ভেবে পড়ে না যে, যা লেখা হচ্ছে তা হুবহু আগামী পাঁচ বছর সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতায় এলে পূরণ করবে। সাধারণ ভোটাররাও ইস্তাহারের বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে দেখে থাকে। কাকে ভোট দেবে– সেটা ঠিক করার মাপকাঠি হিসাবে নয়।
কোনও দলের ইস্তেহারে এটা বলা হয় না যে, পাঁচ বছর আগে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো কেন পূরণ করতে পারেনি বা কেন পূরণ করা সম্ভব হয়নি। যেমন এবার সব রাজনৈতিক দলের ইস্তেহারে গুরুত্ব পেয়েছে দেশের কৃষি সমস্যার কথা। দেশের এই কৃষি সংকট একটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এর আগেও বিভিন্ন ভোটে রাজনৈতিক দলগুলি কৃষি সমস্যা সমাধানের কথা তাদের ইস্তেহারে বলেছে। কিন্তু সেই পথে কাজ করে কি কৃষি সমস্যা সমাধান করা গিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তেহারে মিলবে না। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের এমন কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে, যার সমাধান এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিঃসন্দেহে কাশ্মীর সমস্যা। এবারও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু অতীতে ইস্তেহারে দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতির পরেও কেন এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি, সেই প্রশ্নের উত্তর কোথাও নেই। দারিদ্র সমস্যাও এইরকম একটি সমাধান না-হওয়া ইস্যু৷
পরিবেশ দূষণ এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা হলেও কোনও দলের ইস্তেহারেই তেমন গুরুত্ব পায়নি। রাজনৈতিক দলগুলি এ ব্যাপারে এতটা উদাসীনতা দেখায় – মনে হয়, এই কারণে যে, ভোটাররা ইস্তেহার গুরুত্ব দিয়ে পড়ে না। সব রাজনৈতিক দলেরই চেষ্টা থাকে ইস্তেহারের মধ্য দিয়ে একটা চমক তৈরি করার। ইস্তেহারে এমন কোনও একটি চমকপ্রদ ঘোষণা রাখা, যা সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হবে। সংবাদমাধ্যমে কোনও একটি বিষয়ে যদি কিছুদিন ধরে চর্চা হয়, তাহলে সেটা দ্রুত অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। যা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা মেলে এবং রাজনৈতিক দলগুলি সেই ধরনের একটা ফায়দা ইস্তাহার থেকে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। প্রতিটি ভোটের ক্ষেত্রে আমরা এই ধরনের দু’-একটি চমকপ্রদ ঘোষণা দেখতে পাই।
ইস্তেহার রূপায়ণ করতে হবে এমন একটি বাধ্যবাধকতা যদি রাজনৈতিক দলগুলির থাকে, তাহলে ইস্তেহারে গোলাপি স্বপ্ন দেখানোর প্রবণতা কমবে। আমরা বাজেটের ক্ষেত্রে যেমন দেখি যে সরকার যে হিসাব দেয়, তার সঙ্গে বাস্তবে কী হল তারও উল্লেখ করতে হয়। অর্থাৎ সরকার কোনও বছরের বাজেটে যেমন বলে– সেই বছরে তাদের প্রস্তাবিত আয় কত ও প্রস্তাবিত ব্যয় কত, তেমন হিসাব দিতে হয় যে আগের বছরের প্রস্তাবিত আয়-ব্যয়ের কতটা বাস্তবে করা গিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে বাজেটের লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে সরকার কতটা সক্ষম হয়েছে। ইস্তেহারের ক্ষেত্রেও যদি এরকমটা করা যায় তাহলে মানুষের মূল্যায়নে সুবিধা হয়। পাঁচ বছর পর যখন একটি রাজনৈতিক দল তাদের নতুন ইস্তেহার প্রকাশ করছে, তখন তারা বলুক যে গত পাঁচ বছরে আগের ইস্তেহার রূপায়ণের ক্ষেত্রে তারা কতটা কী করতে পেরেছে। যে দল জিতে সরকারে যায়, তাদের ক্ষেত্রে এই বলার দায়টা অবশ্যই বেশি। কারণ শাসক দলকে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রূপায়ণ করতে হয়। যারা বিরোধী থাকে তাদের উপরেও কিছুটা দায় বর্তায়। তাদের বলতে হবে তাদের দেওয়া ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতিগুলি নিয়ে তারা সরকারের উপর কতটা চাপ তৈরি করেছে। সেই ইস্যুগুলি নিয়ে জনগণের মধ্যে মতামত তৈরির ক্ষেত্রে তারা কতটা ভূমিকা নিয়েছে। ইস্তেহারের দাবিগুলো নিয়ে তারা কতটা মানুষের মধ্যে প্রচার করেছে, আন্দোলন করেছে। এই পদ্ধতি যদি চালু করা যায়, তাহলে একদিকে যেমন মানুষের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলির দায়বদ্ধতা বাড়ে, তেমন দেশ ও গণতন্ত্রেরও মঙ্গল হয়৷ ভোটের আগে ইস্তেহার প্রকাশ না করতে পারলে রাজনৈতিক দলগুলির প্রচার শুরু হয় না। কিন্তু কোনও দলের ইস্তাহারেই বলা হয় না যে পাঁচ বছর আগে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো কেন পূরণ করা সম্ভব হয়নি। ইস্তেহার রূপায়ণ করতে হবে– এমন একটি বাধ্যবাধকতা যদি রাজনৈতিক দলগুলির থাকে, তাহলে ইস্তেহারে গোলাপি স্বপ্ন দেখানোর প্রবণতা কমবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.