Advertisement
Advertisement

Breaking News

চিন

আমদানির বিকল্প প্রস্তুতিকে হাতিয়ার করে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ই বাঁচার পথ

চিনা পণ্যের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে।

Self reliance is the only way out of economic turbulence
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 30, 2020 5:10 pm
  • Updated:June 30, 2020 5:46 pm

সুতীর্থ চক্রবর্তী: অর্থনীতিতে আমরা বলে থাকি আমদানির ‘বিকল্প প্রস্তুতি’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর রেডিওর অনুষ্ঠানে চিনের নাম না করে দেশকে যে বিকল্প পথ গ্রহণের কথা বলছেন, তা অর্থনীতির ভাষায় আমদানির বিকল্প প্রস্তুতি। যেসব পণ্য আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করে এনে ব্যবহার করি, তা দেশে উৎপাদন করার জন্য পরিকল্পনা রচনা বা ব্যবস্থাগ্রহণই হল আমদানির বিকল্প প্রস্তুতি। এটা করতে গেলে সবার আগে আমদানির সংকোচন করতে হবে। শুধু দেশবাসীকে চিনা (China) পণ্য বয়কট করার ডাক দিলেই হবে না। সরকারকেও আমদানি সংকোচনের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করতে হবে। কী সেই পদক্ষেপ? হয় আমদানির উপর চড়া শুল্ক বসাতে হবে, অথবা কতটা পণ্য আমদানি হবে, তার একটি ঊর্ধ্বসীমা রচনা করে দিতে হবে। বিদেশি পণ্যের আমদানি সংকোচ করে বা বেঁধে দিয়ে একইরকম পণ্য দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে।

[আরও পড়ুন: নভেম্বর পর্যন্ত ফ্রি রেশন, ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’-এর লক্ষ্যে বড় ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর]

শিল্পে পিছিয়ে থাকা দেশগুলি আমদানির বিকল্প প্রস্তুতি দিয়ে শিল্পায়নের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করে। এটা অপেক্ষাকৃত সহজ পথ। কারণ যে যে পণ্যের আমদানি সংকোচন করে বা বেঁধে দিয়ে সেই পণ্য দেশের ভিতর উৎপাদন করার চেষ্টা হয়, সেগুলির একটি তৈরি বাজার থাকে। কোনও পণে্যর তৈরি বাজার থাকলে সেইসব পণ্য উৎপাদনে লগ্নির অভাব হয় না। এখন আমরা যেসব চিনা পণ্য আমদানি করি, তার দেশে একটি তৈরি বাজার আছে। লাদাখে (Ladakh) চিনের নৃশংস হামলায় কর্নেল-সহ ২০ ভারতীয় জওয়ানের মৃত্যুর পর চিনা কোম্পানির মোবাইল ফোনের বিক্রি দেশের বাজারে অস্বাভাবিকভাবে কমে গিয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে কোনও পদক্ষেপ করতে হয়নি। চিনা মোবাইলের যন্ত্রাংশ আমদানি প্রশাসনিক নির্দেশে সংকোচনও করতে হয়নি। চিনের প্রতি ক্রোধ থেকেই ভারতবাসী চিনা কোম্পানির মোবাইল ফোন কেনা কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতে এখনও আমাদের আমদানির বিকল্প প্রস্তুতি নীতির কোনও প্রয়োগ ঘটেনি। গত কয়েক দিনে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি কোম্পানি তাদের মোবাইল ফোনের দাম অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, মোবাইল ফোনের বাজারটা ভারতের কোম্পানির জায়গায় ধরে ফেলছে কোরিয়ার কোম্পানি। চিন বিরোধী মনোভাব থেকে আমদানির বিকল্প প্রস্তুতির সুবিধা শিল্পায়নের স্বার্থে গ্রহণ করতে হলে দেশি লগ্নির বিষয়টিও সুনিশ্চিত করতে হবে।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী চিনের নাম না করে চিনা পণ্য বয়কটের আওয়াজ তুলেছেন, একইসঙ্গে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের কথাও বলেছেন। আমদানি-কৃত চিনা পণ্যের বিকল্প স্বদেশি পণ্যটির জোগান বাজারে সুনিশ্চিত করাই হল আমদানির বিকল্প প্রস্তুতি। চিনা মোবাইল ফোনের ‘বিকল্প’ হিসাবে যদি দেশের মানুষ কোরিয়ার বা আমেরিকার কোম্পানির মোবাইল ফোন কেনা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে দেশি শিল্পপ্রসার তথা ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার কাজে কোনও ফায়দা আসবে না। ভারতে জনপ্রিয় চিনা মোবাইল কোম্পানি তাদের দোকানগুলির সাইনবোর্ডে লিখছে- ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’। মানুষের তাৎক্ষণিক ক্ষোভ এড়াতেই এরা এই কাজ করছে। তাতে চিঁড়ে খুব একটা ভিজছে না বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’-র গুরুত্বটাও লোককে বোঝাতে হবে। চিনা পণ্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’-র জনপ্রিয়তায় পর্যবসিত করা গেলেই এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। একদিকে চিনা পণে্যর বিক্রি কমিয়ে চিনকেও আর্থিকভাবে কিছুটা শিক্ষা দেওয়া যাবে, অন্যদিকে ভারতীয় পণে্যর বিক্রি বাড়িয়ে দেশে শিল্পপ্রসারেও কিছুটা সহায়ক ভূমিকা নেওয়া যাবে।

Advertisement

স্বাধীনতার পর দেশে দ্রুত শিল্পায়নের লক্ষ্যে আমদানির বিকল্প প্রস্তুতির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা যে লাভ দেয়নি, তা বলা যাবে না। মোটের উপর স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশকে দেশের শিল্পে যে অগ্রগতি, তা এই আমদানির বিকল্প প্রস্তুতিতে ভর করেই। সুনির্দিষ্ট করে বললে ১৯৫৬ সালে গৃহীত দেশের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, যেটি ‘মহলানবিশ মডেল’ হিসাবেও পরিচিত, সেখানে আমদানির বিকল্প প্রস্তুতির উপর ভর করেই দ্রুত শিল্পায়নের কথা বলা হয়েছিল। শিল্পায়নের হাত ধরেই এসেছিল দ্রুত নগরায়ন ও শিক্ষার বিস্তার। যদি সে সময় ‘আধুনিক ভারত’ বলে কিছু গড়ে ওঠে, তাহলে তার চালিকাশক্তি ছিল কিন্তু এই আমদানির বিকল্প প্রস্তুতি। ১৯৯১ সালে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণ নীতি গ্রহণের পর থেকে আমরা আমদানির বিকল্প প্রস্তুতির পথ থেকে সরে এলাম। তখন বলা হল বাণিজ্যভিত্তিক আর্থিক বৃদ্ধির কথা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করেই আমাদের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। আমদানির উপর বাধা তৈরি করে শিল্পপ্রসার করার নীতি নেওয়া যাবে না। কারণ তাতে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি গতি পাচ্ছে না। হারাচ্ছি দক্ষতাকে। আমদানির বিকল্প প্রস্তুতির সুযোগ নিয়ে দেশের একদল শিল্পে উদ্যোগী একটি অদক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল বলে অভিযোগ তোলা হয়। অভিযোগ ওঠে দেশে আমলাতন্ত্রের ফাঁসে আটকে থাকা দুর্নীতিগ্রস্ত একটি আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মূলেও এই আমদানির বিকল্প প্রস্তুতি। একদল ব্যবসায়ী দুর্নীতি করে শাসকদলের নেতাদের ও আমলাদের ঘুষ দিয়ে এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে শুধু ফুলেফেঁপে উঠছে। এতে দেশের শিল্পোৎপাদন গতি পাচ্ছে না। উপভোক্তারা উন্নত মানের পণ্য পাচ্ছে না। তাই বাজারে ভোগ্যপণে্যর চাহিদাও বাড়ছে না। আর্থিক বৃদ্ধিও লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে না।

১৯৯১ সালে যেকথা বলে আমরা আমদানির বিকল্প প্রস্তুতির পথ থেকে সরে এলাম, গত তিন দশকে কি তার অসাড়তা উপলব্ধি করছি? মহামারী আজ আমাদের সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। কারণ নিজেদের অর্থনীতিকে বাঁচাতে দেওয়াল তুলছে সব দেশ। আমাদের রপ্তানি, বিদেশি লগ্নি সব মার খাচ্ছে। অন্যদিকে বাজার হারিয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশি সংস্থা। লাদাখে চিনের সঙ্গে যুদ্ধের পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট করে বাস্তবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। চিন একটা মহামারী পরবর্তী বিশ্বের স্বপ্ন দেখছে। আমেরিকাও তাদের অভিসন্ধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত বিরোধিতার প্রেক্ষিতে আমেরিকা চিনের সঙ্গে একটা কূটনৈতিক ও বাণিজি্যক সন্ধিতে গিয়েছিল। চিন যার সুযোগ গ্রহণ করে নানাভাবে বলীয়ান হয়েছে। সোভিয়েতের পতনের পর চিনের সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে রাশিয়ার। মহামার-উত্তর বিশ্বে চিন ও রাশিয়ার এই অক্ষই ক্ষমতার একটি নতুন ভরকেন্দ্র হতে চায়। এই দড়ি টানাটানিতে নাভিশ্বাস উঠছে ভারতের। ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর স্লোগান ছাড়া এখন বাঁচার পথ নেই। আত্মনির্ভর ভারত স্লোগান রূপায়িতও হবে না আমদানির বিকল্প প্রস্ততি ছাড়া।

প্রধানমন্ত্রী বলছেন লাদাখে চিনকে উচিত জবাব দেওয়া গিয়েছে। আরও শিক্ষা দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন তিনি। ইতিমধ্যে দেশে চিনা কোম্পানির কয়েকটি বরাত বাতিলও করেছে সরকার। কিন্তু এই জবাব কখনওই সম্পূর্ণ হবে না চিনা পণ্যের উপর আমাদের নির্ভরতা না কমানো গেলে। নাহলে নয়া বিশ্বব্যবস্থায় চিন আমাদের আরও গিলে খাবে। মহামারী চোখ খুলে দিয়েছে। লাদাখ বাস্তবের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমদানির বিকল্প প্রস্তুতিই হোক আমাদের নয়া হাতিয়ার। তিন দশক আগে আমরা যে নীতিকে ছেঁড়া চটির মতো ছুড়ে ফেলেছিলাম, তাকেই আবার গ্রহণ করা হোক। অর্থনীতি বাস্তব পরিস্থিতিকে বাদ দিয়ে নয়। বাস্তবের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গেই তা তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলে।

[আরও পড়ুন: আর্টিমিসিয়া গাছের নির্যাস কি করোনার অব্যর্থ দাওয়াই? আশার আলো দেখছেন বিজ্ঞানীরা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ