Advertisement
Advertisement

Breaking News

Mamata Banerjee

সম্পাদকীয়: খেলা হল বটে

এবারের ভোটে মেরুকরণে কি বিজেপি সফল?

WB Assembly polls: Bengal witnessed startling political 'Khela' | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:April 28, 2021 7:35 pm
  • Updated:April 28, 2021 7:35 pm

কিংশুক প্রামাণিক: একমাস কুড়ি দিন। তার মধ্যে ৪৩ দিন হুইলচেয়ারে। ধৈর্য, সাহস, পরিশ্রম, বুদ্ধি, জেদ। আর কী কী শব্দ বসাব, জানি না। এককথায়, এক অবিশ্বাস্য সফর। একটা অতীব শক্ত ম্যাচকে এভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ‘সহজ’ করে দিলেন কি না- সেটা ২মে বোঝা যাবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও দেখিয়ে দিলেন, বুকের পাটা থাকলে যত প্রতিবন্ধকতাই থাকুক, একাই একশো হওয়া যায়। ভাগ্য তাঁর সঙ্গেই থাকে, যিনি সাহসী।

[আরও পড়ুন: ধন্যি বন্ধুত্ব! ১৩০০ কিমি পেরিয়ে করোনা আক্রান্ত বন্ধুকে অক্সিজেন পৌঁছে দিলেন যুবক]

Advertisement

যতই তিনি বলুন, আমি গোলকিপার, আদতে তৃণমূলের তিনিই স্ট্রাইকার, তিনিই মিডফিল্ডার, তিনিই ডিফেন্ডার, তিনিই কোচ। ‘একা বনাম এগারো’-র ফুটবল ম্যাচের ফল জানতে আগামী রবিবার নিশ্চয় অধীর আগ্রহে বসে থাকবে দেশ। মূলত তাঁর ভাঙা পা নিয়ে যুদ্ধের জন্যই পাঁচ রাজ্যের ভোটের সবটুকু আকর্ষণ শুষে নিয়েছে এই রাজ্য।

Advertisement

১৯৯৬ সাল থেকে সাংবাদিক হিসাবে ছয়টি বিধানসভা ও ছয়টি লোকসভা ভোট দেখেছি। কিন্তু আট দফার এমন আশ্চর্য ভোট বোধকরি আগে কখনও মমতাও দেখেননি। তিনিও ১৯৮৪ সাল থেকে ভোটে লড়ছেন। এবার প্রতি দফার আলাদা আলাদা ইস্যু। আলাদা আলাদা সমীকরণ। প্রতিপক্ষ শিবিরের আস্তিন থেকে এক-এক দফায় বেরিয়ে আসছে একেক রকম অস্ত্র। দফাওয়ারি আলাদা পাটিগণিত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে এসে ১৮টি জনসভা করেছেন। তার মধ্যে ব্রিগেডও রয়েছে। এছাড়াও ভোট ঘোষণার আগে হলদিয়া ও হুগলিতে কর্মসূচি করেছেন। অন্য কোনও রাজ্যে মোদি এভাবে ভোটের সময় আগে কখনও গিয়েছেন কি না, তা জানা নেই। তবে বাংলায় তিনি রেকর্ড করেছেন।

কংগ্রেস আমলে প্রধানমন্ত্রীরা অথবা এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁদের দলের হয়ে ভোটের প্রচারে এসেছেন। দু’চারটির বেশি সভা তাঁরা করেননি। আগে প্রথা ছিল, উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গে একটি করে সভা। এবার প্রধানমন্ত্রী প্রায় সব জেলা ছুঁয়ে গিয়েছেন। কার্যত ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন। এমনকী, প্রচারের বিধি-নিষেধ জারি হলে ভারচুয়াল সভা করেছেন।বিজেপির প্রচারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। স্থানীয় নেতার মতো গত দু’-মাসে রাজ্যে প্রায় দিনই পাড়ায়-গ্রামে সভা করেছেন, রোড শো করেছেন। বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, তাঁর ও সর্বভারতীয় সভাপতি জে. পি. নাড্ডার কর্মসূচি মেলালে সংখ্যা হবে শতাধিক।

এছাড়াও রাজনাথ সিং, নির্মলা সীতারমণ, স্মৃতি ইরানি-সহ বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সাংসদ প্রচারে এসেছেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ-সহ অনেক মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় টিম বহু দিন ধরে রাজ্যে বসে ভোটের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। সব সূচি মেলালে ২৯৪ বিধানসভা আসনের জন্য দু’-তিনমাসে কয়েক হাজার কর্মসূচি করেছে বিজেপি। ভোটে জিততে বিশাল দলকে পুরোদস্তুর কাজে লাগিয়েছে তারা। প্রচারে দেদার টাকা খরচ হয়েছে।
ফ্ল্যাগ-ফেস্টুন-ফ্লেক্স-রথ কোনও কিছুর অভাব ছিল না। হেলিকপ্টার, চার্টার্ড প্লেন ছিল প্রয়োজনের থেকে বেশি। বাংলা দখল করতে কার্পণ্য করা হয়নি।

স্বভাবতই অনেক যুদ্ধ লড়লেও অতীতের কোনও নির্বাচনে এত বড় আক্রমণের মুখে মমতা পড়েননি। উনিশের লোকসভা ভোটের সময়ও নয়। বিজেপির প্রচারে আইটি সেলের ভূমিকা ছিল বিরাট। সব মিলিয়ে বিশাল প্রতিপক্ষ। অন্যদিকে একা একজন। তিনি আবার হুইলচেয়ারে। তৃণমূ্‌লের প্রচারেও এবার ছিল অভিনবত্ব। জন্মলগ্ন থেকে দলটাকে দেখছি। এত পেশাদারিত্ব আগে কোনও ভোটে দেখিনি। সব সভার মঞ্চ ছিল একরকম। একটিই স্লোগান, ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। ব্যাকড্রপে শুধু বদলে যেত কেন্দ্র আর প্রার্থীর মুখ। মুখ্যমন্ত্রীর মুখের নেপথ্যে থাকত স্থানীয় ছবি। বিষ্ণুপুরে যেমন টেরাকোটার ঘোড়া, সুন্দরবনের বাঘ, কালচিনির চা বাগান। প্রচারসভায় বাজত তিনটি গান। একটি কবীর সুমনের ‘বাংলা থাকুক বাংলায়’। একটি ইন্দ্রনীল সেনের। সব শেষে ‘খেলা হবে।’ কোনও জনসভাতে এই ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়নি। দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে সভা ভরিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। হেলিকপ্টার নামার পর অস্থায়ী র‌্যাম্প দিয়ে হুইলচেয়ার টেনে আনা হত মূল মঞ্চে। মুখ্যমন্ত্রীর পাশে একটি ছোট্ট টেবিলে থাকত জল, স্যানিটাইজার, কারা মঞ্চে আছেন সেই কাগজ। প্রথম দিকে করোনা কম ছিল। দূরত্ববিধি তেমন ছিল না। পরের দিকে কঠোরভাবে তা মানা হলেও প্রার্থী অথবা নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলতেই হয় দলনেত্রীকে। মাস্ক না পরার জন্য ধমকও খেয়েছেন কেউ কেউ। মুখ্যমন্ত্রীর সৌভাগ্য, দেড়মাস ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্পর্শ করে এলেও তিনি নিজেকে সংক্রমণ-মুক্ত রাখতে পেরেছেন। সব মেলালে পঞ্চাশ দিনে দেড়শোর বেশি কর্মসূচি। তাঁর আক্ষেপ, শেষদিকে আচমকা বিধি-নিষেধের গেরোয় আরও কুড়িটি সভা তিনি করতে পারেননি। ভরদুপুরের গরম, ধুলোর পথ পেরিয়ে শসা আর দইয়ের ছাঁচ, লেবু জল খেয়ে হুইলচেয়ারে বাংলা সফর শেষ করেন।

তাঁর বিরুদ্ধে কার্যত চক্রবূ্যহ তৈরি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপি সভাপতি-সহ গেরুয়া বাহিনীর সবাই তাঁকে নিশানা করেছেন। দলত্যাগী নেতাদের আক্রমণের ভাষার কোনও মাপকাঠি ছিল না। সিপিএম-কংগ্রেস নেতৃত্ব থেকে শুরু করে কালকের নেতা ভাইজানও বিজেপির চেয়ে অধিক সময় ব্যয় করেছেন তাঁকে নিয়ে। সর্বোপরি, নির্বাচন কমিশন। নন্দীগ্রাম থেকেই মমতা বলেছিলেন, আমরা বিচার পাচ্ছি না। কমিশন চালাচ্ছেন অমিত শাহ। সেই সংঘাত শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে গেল যে, তাঁকে ২৪ ঘণ্টা প্রচার থেকে দূরে থাকতে হল।

এবারের ভোটে কমিশনের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু তাদের ভূমিকা যে যথাযথ ছিল না, তা তো বোঝাই যায় মাদ্রাজ হাই কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় রাজ্য পুলিশকে পিছনে রেখে। বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে তৃণমূল শুরু থেকেই সরব ছিল। শীতলকুচিতে বাহিনীর গুলিতে চার যুবকের মৃত্যুতে আগুনে ঘি পড়ে। সেদিন কেন গুলি চালাতে হয়েছিল, তার যেমন প্রমাণসাপেক্ষ তথ্য কমিশন আজও দিতে পারেনি, তেমনই বুকে-পিঠে কেন গুলি- তার ব্যাখ্যাও অজানা।

আসলে টি. এন. শেষন নামক এক ভদ্রলোক ভারতীয় জণগনকে যে নতুন নির্বাচন ব্যবস্থা উপহার দিয়েছিলেন, তা ভোটকে অবাধ ও স্বচ্ছ করে তোলে। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, এবার শুরু থেকেই মেরুদণ্ডের অভাবটা চোখে পড়ে। খেসারত দিতে হল। নির্বাচন ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা যদি প্রশ্নের মুখে পরে তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?

যে-কথা শুরুতে বলছিলাম। এবার প্রতি দফার ইস্যু ছিল আলাদা। মমতাও ধাপে ধাপে তাঁর অস্ত্রগুলো সামনে এনেছেন। শুরুতে ‘বাংলা ও বাঙালি’, ‘বহিরাগত’ ইস্যুর প্রচার ছিল তুঙ্গে। তারপর তিনি বোঝাতে শুরু করেন, প্রার্থীকে ভোট মানে তাঁকেই ভোট। স্থানীয় জোড়াফুল প্রার্থীকে না-জেতালে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না। আর তিনি মুখ্যমন্ত্রী না হলে বন্ধ হয়ে যাবে রেশন, সাইকেল, ট্যাব, ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’-র টাকা, নানারকম ভাতা, মৃতদেহ সৎকারের অর্থ। পাঁচ লক্ষ টাকার ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ডটাও হয়ে যাবে বেকার। মজা হল, এই উপভোক্তা শ্রেণির প্রকল্পগুলো একান্ত মমতার। ফলে, বিজেপি বলতে পারেনি, তারা জিতলে এইগুলো সতি্য বন্ধ হবে না। মমতা এই সুযোগ নিয়েছেন বুদ্ধি করে।

এরপরে আসে বিজেপির মেরুকরণ তাস। দফা এগোতেই বিজেপি বুঝে যায়, এটাই শেষ অস্ত্র। নন্দীগ্রামে মেরুকরণের প্রচার এতটাই তীব্র করা হয় যে, ভোটের দিন বয়ালে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। মমতা সেখানে গিয়ে কার্যত ধরনায় বসে পড়েন। চতুর্থ পর্বে শীতলকুচির ঘটনা নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে তোষণের তত্ত্ব খাড়া করেন বিজেপি নেতারা। যদিও অানন্দ বর্মণের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তা প্রতিহত করেন।

অনেকেই জানতে চাইছেন, এবারের ভোটে মেরুকরণে কি বিজেপি সফল? সেটা ভোটবাক্স না খুললে বোঝা শক্ত। দু’টি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। সংখ্যালঘু প্রধান চাকুলিয়াতে একই সময়ে ছিল মমতা ও অমিত শাহ-র সভা। কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধান। দেখেছিলাম, মুসলিমরা চলেছেন মমতার সভায়। শাহ-র সভার দিকে যাঁরা যাচ্ছিলেন, তাঁরা হিন্দু। তার দেড় ঘণ্টা পরে কালিয়াগঞ্জে মমতার সভার পথে দেখি জোড়াফুল পতাকায় মোড়া টোটোয় দুই গৃহবধূ। একজনের সিঁথিতে সিঁদুর, অন্যজনের মাথায় হিজাব। এই ছবিটা মমতার সব সভাতেই ছিল। সামনেটা দখলে থাকত মহিলাদের। সেই ব্লক থেকে উলুর আওয়াজ ও দোয়া চেয়ে হাততালি উঠত সমান-সমান। অর্থাৎ, বিজেপির মেরুকরণ স্ট্র্যাটেজি সেখানেই সফল হয়েছে, যেখানে হিন্দু ও মুসলিম গ্রাম মুখোমুখি। সার্বিকভাবে হিন্দুপ্রধান এলাকায় তৃণমূল তাদের ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে পেরেছে বলেই অনুমান। তাই যদি মেরুকরণ হয়ে থাকে, তবে সেটা মুসলিম ভোটে সার্বিক হয়েছে। বিজেপির সঙ্গে যুদ্ধে তাঁরা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। তদুপরি, ভোটের অঙ্ক সব সময় মেলে না। আদিবাসী, মতুয়া, রাজবংশী, তফসিলি ভোটও বাংলার রাজনীতিতে এখন বিরাট ফ্যাক্টর। মমতার প্লাস পয়েন্ট, এই ভোটটা ছিল তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার। ‘বিকল্প মুখ’ বিজেপি তুলে ধরতে পারেনি। ফলে পপুলার ভোট মমতা পাবেন।

শেষ তিন দফায় আবার ইস্যু বদলে যায়। করোনার ভয়ংকর থাবা হয়ে গেল প্রচারের মূল দিক। মমতা রাজনীতির ঘ্রাণ বোঝেন, তাই চতুর্থ দফা থেকে এ নিয়ে সরব ছিলেন। অভিযোগ ছিল, বিজেপি বাইরে থেকে লোক আনছে, তারা করোনা ছড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীরও পরীক্ষা হয়নি। কমিশনের কাছে দাবি করেন, শেষ তিন পর্বের ভোট ক্লাব করে একদিনে করতে। যদিও প্রচারে রাশ টেনে অনেকে দেরিতে সিদ্ধান্ত নিল কমিশন। বিজেপির প্রচারও বিরাটভাবে ব্যাহত হল দেশজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ায়। তাদের মূ্‌ল কাণ্ডারি নরেন্দ্র মোদি শেষ দিকে আসতেই পারলেন না। কলকাতা দখলের জন্য বিজেপির প্রচারের নানা ছক এলোমেলো হয়। বাংলার ভোটে ইস্যু হয়ে উঠল অক্সিজেন না-পেয়ে দিল্লিতে রোগীর মৃত্যু। কাজেই আট দফার চূড়ান্ত বিরোধিতা করলেও, নিজের মতো করেই এই যুদ্ধ লড়ে গেলেন তৃণমূলনেত্রী। যে বিজেপি তাঁকে ‘কোবরা’-র ছোবল দিতে চেয়েছিল, তাকে একইঞ্চিও জমি ছাড়লেন না। তাহলে বাংলা থাকল কি বাংলায়? উত্তর বন্দি ইভিএমে। ২ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। খেলা হল বটে একটা।

[আরও পড়ুন: দেশজুড়ে অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে বড়সড় ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ