শম্পালী মৌলিক: একটা সিনেমা কয়েক ঘণ্টার মাত্র, সেই সময়টা যদি মস্তিষ্কে অভিঘাত তৈরি করে, রয়ে যায় ছবিটা। মনে মনে আমরা ফিরে যাই সেই দৃশ্যকল্পের দিকে, সেই সংলাপের কাছে। তখন সিনেমা সার্থক হয়ে ওঠে। নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নবতম প্রয়াস ‘আমার বস’ ছবিতে সেইরকম কিছু মুহূর্ত যেন মালায় গাঁথা। বর্তমান সময়ের নাগরিক জীবনের ছবিটা তুলে ধরে চিত্রনাট্য। তাঁদের আগের ছবিটি ছিল থ্রিলার-ঘেঁষা, এই ছবিতে তাঁরা ফিরে গিয়েছেন বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান অন্বেষণের পথে। কাজের জীবনের চাপ এবং দ্রুতি আমাদের ভিতরকার নরম মনটা নষ্ট করে দেয়। কর্পোরেট জগতে তা আরও নাভিশ্বাস তোলে। ক’জন মালিক কর্মচারীর পারিবারিক পরিস্থিতি বা তার মনের খবর রাখেন? সেখানে আউটকাম-ই শেষ কথা। এই ছবির নায়ক অনিমেষ (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) একটি পাবলিশিং হাউস চালায়। নিজ কর্তব্যে অবিচল। কর্মচারীদের সঙ্গে তার নরম-গরম সম্পর্ক, খানিক টক্সিক বলা যায়। অন্যদিকে তার বৈবাহিক জীবনে চলছে ভাটার টান। স্ত্রী মৌসুমীর সঙ্গে (শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়) তার জীবনযাত্রায় বিস্তর ফারাক। অন্যদিকে অনিমেষের বাড়িতে বয়স্ক মা শুভ্রাদেবী (রাখী গুলজার) বলা যায় মা অনিমেষের নির্ভরতার হেলান, যখন সে কাজ সেরে বাড়ি ফেরে মা তার মনের আরাম। বয়স হয়েছে বলে মায়ের সিদ্ধান্তের জোর কমে গিয়েছে, এমনটা নয়। আদরের লাড্ডু নার্স রেখেছে বাড়িতে মায়ের জন্য কিন্তু মা চায় ছেলের স্পর্শ, নইলে তার খাবার বিস্বাদ লাগে।
একদিন শুভ্রাদেবী বাড়িতে না থেকে ছেলের সঙ্গে অফিস যেতে চান। ঢুকে পড়েন ছেলের কাজের জগতে। অনিমেষ-শুভ্রার তাল-ছন্দ আলাদা। দৃষ্টিভঙ্গিও পৃথক। ফলে কর্মচারীদের সঙ্গে দুই ধরনের সম্পর্ক দেখি তাদের। তারই মধ্যে মা-ছেলের অন্তর্লীন মায়া-ঝগড়া-খুনসুটি আল্পনার মতো আঁকা হয় তাদের রোজকার জীবনে। আমরা যেমন ‘মিটিংয়ে আছি’ বলে মায়ের ফোন মিস করি লাড্ডুও তেমন। এখানে মা ‘ব্যস্ত আছি’ বলে, এবার ছেলের ফোন ধরতে পারে না! ক্রমশ কর্পোরেট অফিসেও মানবিকতার মাধুর্যের ছোঁয়া লাগে। ভাবতে ভালো লাগে- যদি এমন হত! আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় অফিসে এমন ‘মা’- কে মিস করব ছবিটা দেখতে দেখতে। আর অফিস- স্পেসে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছবিটার সম্পদ। কর্পোরেট জীবনে এমনটা হয় না, কিন্তু হতে কি পারে না? এই জন্যই তো সিনেমা। অফিসের দুই সহকর্মীর চরিত্রে গৌরব চট্টোপাধ্যায় আর সৌরসেনী মৈত্রর রোমান্টিক আভাস ভীষণ আকর্ষণীয়। বাকিদের সম্পর্কে প্রতিযোগিতা নেই, তার বদলে আছে বেঁধে বেঁধে থাকার প্রয়াস। এই অফিসেই শুভ্রাদেবী আসার পর এক আশ্চর্য ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন তিনি নিজে। তখন বোঝা যায় আসল ‘বস’ কে? সেই সব প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখাই ভালো। ছবিতে নাচ-গান-নাটক ভরপুর, তবে ওমনিপ্রেজেন্ট মা সবচেয়ে ছুঁয়ে যায়। যাঁদের মা নেই তাঁরা শূন্যস্থানটা অনুভব করবেন ছবি দেখতে গিয়ে। আর যাঁদের মা আছেন, তাঁরা আরও বেশি করে আদরে-যত্নে মুড়ে দেবেন মাকে, কিংবা হয়তো অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করবে একটু আগে মায়ের জন্য। আর ক্লাইম্যাক্সের প্রহর গুণতে ভালো লাগবে।
এবার আসি অভিনয় প্রসঙ্গে। রাখী গুলজার এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই এই ছবির নিউক্লিয়াস। তাঁদের রসায়ন অব্যর্থ। এতদিন পর রাখী ‘অভিনয়’ করছেন মনেই হয়নি। তাঁদের পাশে শ্রাবন্তী-শিবপ্রসাদের রোমান্স কিংবা ব্যবধানের চোরাটান ফিকে লাগে। তবে শিবপ্রসাদের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দশে-দশ পাওয়ার যোগ্য। আবেদনমুখর উপস্থিতি সৌরসেনীর আর গৌরব চরিত্রের অসহায়তা ধরেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তাঁদের কাছাকাছি আসার দৃশ্যে সাহানা বাজপেয়ীর কণ্ঠে ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’ বহুদিন শুনতে থাকব। অফিসের প্রাণ হয়ে উঠলেন যাঁরা- কাঞ্চন মল্লিক, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, উমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আভেরি সিনহা রায়, বিমল গিরি, তরুণ চক্রবর্তী, ঐশ্বর্য সেন, শ্রুতি দাস- প্রত্যেকে সাবলীল।
প্রচেত গুপ্ত, তিলোত্তমা মজুমদারের ক্যামিও ছবির চমক, এছাড়া আরও মণিমুক্ত আছে, প্রেক্ষাগৃহে আবিষ্কার করাই ভালো। দ্বিতীয়ার্ধের বিরাট প্রাপ্তি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের এফর্টলেস অভিনয়। তিনি আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী। তাঁর জন্য এন্ড ক্রেডিট পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। বেশ ভালো লাগে প্রস্মিতা পালের কণ্ঠে ‘বসন্ত ডেকেছে’ গানটা। ছবির সুরকার অনুপম রায়ের কণ্ঠে ‘মালাচন্দন’ সেরা প্রাপ্তি। এত ভালো লেখা এবং সুর যে মাথায় অনুরণিত হবে ছবি শেষ হলেও। তবে দ্বিতীয়ার্ধের টেনশন আরও টানটান হলে মন্দ হত না। গানে যে রোমান্সের উতল হাওয়া, অনি আর মৌয়ের প্রেমের মুহূর্তগুলো অতটাই রসায়ন দাবি করে। সব মিলিয়ে দেশের এই অশান্ত পরিস্থিতিতে এই ছবির সামাজিক বার্তা যেন শান্তিজলের মতো। অভিনন্দন লেখক-পরিচালক নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জুটিকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.