গৌতম ভট্টাচার্য: আটত্রিশ বছর আগে পাওয়ার প্লে নামক শব্দ ক্রিকেটের দূর দিগন্তেও ছিল না। কিন্তু কবীর খান (Kabir Khan) আধুনিক সময়ের পরিচালক। পাওয়ার প্লে-র শুরুতেই তাই দুর্দান্ত রিভার্স সুইপ ।
কী না ফিল্মে লালা অমরনাথের চরিত্রে পুত্র মোহিন্দর। লালাজি চুরুট খেতেন। ‘৮৩’ দেখাল, চুরুট খেতে খেতে একরাশ লোকের মধ্যে টিভিতে নিজের ছেলের বিশ্বকাপ সাফল্য দেখছেন লালাজি। আর তারিফ করছেন। আর একবার শুনুন। স্ক্রিনে তিরাশির বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ও ফাইনালের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ মোহিন্দরের চরিত্রে পর্দায় ফুটে উঠছেন অভিনেতা সাকিব সালিম। আর তাঁর অনমনীয় পারফরম্যান্স টিভিতে লাইভ দেখে যিনি হাসিতে ফেটে পড়ছেন, তিনি কিনা সেই সাফল্যের রূপকার স্বয়ং মোহিন্দর।
শেষ করিনি। টানব্রিজ ওয়েলসের অমর ম্যাচে কপিল দেবরূপী (Kapil Dev) রণবীর সিংয়ের (Ranveer Singh) বিশাল বিশাল ছক্কা মাঠ পেরিয়ে গিয়ে পড়ছে। দর্শকাসনে বসে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সেরকমই একটা ছক্কা দেখে যাঁর একগাল হাসি,ক্যামেরা কাছ থেকে তাঁকে ধরল- কপিল। অর্থাৎ জিম্বাবোয়ের সঙ্গে করা সেই অলৌকিক ১৭৫ স্ট্যান্ডে বসে যিনি দেখছেন তিনিই ওটা আদতে ঘটিয়েছিলেন।
১৯৮৩ আর ২০২১ বারবার গুলিয়ে যাবে। বারবার গুলিয়ে যাবে কোনটা বর্তমান? কোনটা অতীত? কোনটা রিল? কোনটা রিয়েল? ‘৮৩’ গায়ে কাঁটা দেওয়া এমন অদ্ভুত অনুভব যা ভারতবর্ষের ঊননব্বই বছর ব্যাপী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে অদ্যাবধি কোনও মুভিওয়ালা এত দরদের সঙ্গে কখনও ফুটিয়ে তোলেনি। ক্রিকেট নিয়ে তো সিনেমা আগেও হয়েছে। বায়োপিক হয়েছে। ‘ইকবাল’ বা ‘লগানের’ মতো সিনেমা হয়েছে, যেখানে গল্পের মাস্তুল এবং গন্তব্য দুটোই ক্রিকেট। কিন্তু সব মিলেজুলেও এই পরিমাণ ক্রিকেট সেখানে পর্দায় দেখানো হয়নি। বলবিন্দর সান্ধু নিজে টেকনিক্যাল পরামর্শদাতা হিসেবে আগাগোড়া ছবির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বলে। শুটিং নিয়মিত তত্ত্বাবধান করেছেন বলে কিনা জানি না। কিন্তু দর্শকের মনে হতে বাধ্য সে টিভি বা ইউটিউবে পুরনো হাইলাইটস নয়। ইংল্যান্ডের মাঠে বসে গরমাগরম ক্রিকেট দেখছে।
পৌনে তিন ঘণ্টার একটা মহানাটকীয় নস্ট্যালজিক সফরে সে ভারতীয় ক্রিকেট পথিককে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বিশ্বকাপ জয়ের চার বছর বাদে একই লর্ডসে এমসিসি-র বাইসেন্টিনারি টেস্ট কভার করতে গিয়ে কপিল দেবকে ঘিরে তেমন কোনও উচ্ছ্বাস দেখিনি। ২৫ জুন আলাদা করে সেলিব্রেটও হত না। কিন্তু যত সময় গিয়েছে তত পুরনো শ্যাম্পেনের মতো বেড়েছে সেই সাফল্য ঘিরে মাদকতা। তাকে বারবার ফিরে দেখার ব্যাকুলতা। ধোনিরা ওয়াংখেড়েতে কাপ জেতার পর মনে হয়েছিল এবার বুঝি এইট্টিথ্রি স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল। তরুণ প্রজন্ম ধোনির ফাইনাল জেতানো ছক্কাতেই এবার থেকে আলোড়িত থাকবে। বা ফাইনাল শেষে শচীনকে কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন বিরাট- সেই ফ্রেমে। ভিভের লর্ডস ফাইনাল ক্যাচ বস্তাপচা পুরনো ব্যাপার। জেনারেশন জেডের কী দায় পড়েছে তার চর্বিতচর্বণ করার ?
কেন সেটা ঘটেনি সেই রহস্যের সমাধান ‘৮৩’ প্রথম কুড়ি মিনিটেই করে দিয়েছে। কপিলস ডেভিলস শুধু তো কাপ জেতেনি। শক্তিশালী ক্রিকেট শ্বেতাঙ্গ দেশের পাহাড়প্রমাণ তাচ্ছিল্য ও অসম্মানকে বদলে দিয়েছিল। সত্যি তো,ম্যানেজার মান সিং যখন লর্ডসে ঢোকার পাস চাইতে যান,আয়োজক দেশের কর্তারা তাঁকে তীব্র বিদ্রুপে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, লর্ডস অবধি পৌঁছবার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে যে পাস নেবেন? সত্যি তো,কপিলের উদ্বোধনী সাংবাদিক সম্মেলনের মন্তব্য- কাপ জিততে এসেছি শুনে হাসিতে লুটিয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ মিডিয়া। সত্যি তো, বিখ্যাত ক্রিকেটলেখক ডেভিড ফ্রিথ পূর্বাভাস করেছিলেন কোনও চান্স নেই ইন্ডিয়ার। ওরা যদি চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে আমার ম্যাগাজিনের সব ক’টা পাতা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে রাজি আছি। এক লাইনে সিনেমাটা তাই ক্রিকেট নয়। কপিল দেব নয়। অবহেলিত, অসম্মানিত, অস্বীকৃত একদল যুবকের তাদের অত্যাচারীদের পাশা উলটে দেওয়ার অসামান্য মানবিক কাহিনি!
কপিল ছাড়া যেমন বিশ্বকাপ হয় না। রণবীর সিংহ ছাড়াও ‘৮৩’ হয় না। ২০১৯-র গ্রীষ্মে যখন ইংল্যান্ডে ফিল্মের শুটিং চলছিল তখন রণবীরকে একাধিক ক্রিকেট অনুষ্ঠানে দেখেছি। আউটডোর লোকেশন শুটিংয়ের একটা বড় অংশ সেই সময় হচ্ছিল। কিন্তু কাছ থেকে দেখে পুরু গোঁফজোড়া ছাড়া কোনও আন্দাজ পাওয়া যায়নি যে কপিল চরিত্রের জন্য কী অসম্ভব রূপান্তর নিজের মধ্যে এনেছেন। আলাউদ্দিন খিলজি বা বাজিরাও চরিত্র ফুটিয়ে তোলা কঠিনতম পরীক্ষা হয়েও তুলনায় অনেক সহজ। লোকের চোখের সামনে কোনো ইমেজারি নেই ঠিক কি ভুল? কিন্তু কপিল দেব হলেন ভারতীয় জনগণের হার্ট বিট। যাঁর অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে হয়েছে শুনলে আজও আসমুদ্র হিমাচলের নবীন সোশ্যাল মিডিয়া ভেঙে পড়ে। প্রতিনিয়ত যিনি জনতার চোখের সামনে। সে কমেন্ট্রি হোক কী কর্পোরেট শো। কী টিভি বিশেষজ্ঞ। ডান গালের ছোট তিলটা থেকে শুরু করে কপিলকে ফুটিয়ে তোলার জন্য রণবীর যে পরিমাণ হোমওয়ার্ক করেছেন ভাবাই যায় না। দশদিন ছিলেন তিরাশির অধিনায়কের দিল্লির বাড়িতে। কিন্তু তারপরেও তো ক্রিকেটীয় শটগুলো বাকি থেকে যায় নন ক্রিকেটারের জন্য। কপিলের বিখ্যাত নটরাজ শট। ছয় মারার উদাত্ত ভঙ্গি। বোলিং অ্যাকশন। প্রতিটি ডেলিভারির আগে শার্টটা একটু ঝেড়ে নেওয়া। ইংরেজি বলতে গিয়ে একটা অদ্ভুত উচ্চারণ তৈরি করা। রণবীর অবিশ্বাস্য। ধোনিতে সুশান্ত অনবদ্য। কিন্তু এত নিখুঁত ছিল না জাতীয় পুরস্কার কমিটির বৈঠকে শ্রেষ্ঠ পুরুষ অভিনেতা নির্বাচনের সময় আগাম কমিয়ে দিতে পারে।
মঙ্গলবার যাঁর বাষট্টিতম জন্মদিন গেল সেই কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্তের রোলে তামিল অভিনেতা জিভা খুব ভাল। ইংল্যান্ডের রানির সামনে পরিচিত হওয়ার সময় শ্রীকান্তের নাক ঝাড়ার খুব মজার একটা দৃশ্য ফিল্মে আছে। ওটা বাস্তবে ঘটেছিল ইন্দিরা গান্ধীর সামনে বিশ্বকাপ জিতে ফিরে আসার সংবর্ধনায়। মদন লাল চরিত্রে হার্দি সাঁনধ ফাটিয়ে করেছেন। সন্দীপ পাটিলের রোলে তাঁর অভিনেতা পুত্র। রজার বিনি হিসেবে খুব ভালো মডেল নিশান্ত ডাহিয়া। মন খারাপ হয়ে যাবে যশপাল শর্মাকে দেখলে। ম্যানচেস্টারের উদ্বোধনী ম্যাচ বা ইংল্যান্ড সেমিফাইনাল- কোনওটাতেই যশপালের ব্যাট ছাড়া ভারত জেতে না। আটত্রিশ বছর পরেও টিমের সবচেয়ে ফিট থাকা তিনি যে আচমকা মধ্যবয়সে ঝরে যাবেন কে জানত? তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘৮৩’ শুরু হয়েছে এটাই তো অদৃশ্য কালো ব্যাজ পরে উপযুক্ত নীরবতা পালন।
সুনীল গাভাস্কর হিসেবে তাহির রাজ ভাসিনও প্রায় নিখুঁত। ‘কোই পোচে’-তে ছিলেন। খুব ব্যক্তিত্বপূর্ণ। একই রকম সুদর্শন চেহারা। শানিত ট্যাকটিক্যাল বুদ্ধি। যিনি প্রথম ম্যাচে একটা সময় বিপর্যস্ত মননের কপিলকে গিয়ে বলে আসেন ,শাস্ত্রীকে আনো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেলএন্ডাররা বাঁ হাতি স্পিন খেলতে পারে না। আবার ফাইনালে সিন্ধুকে বোঝান, যে বলটা ভেতরে সুইং করবে সেই ডেলিভারিতে গ্রিপ আড়াল করো। গ্রিনিজ যেন তোমার হাত দেখতে না পায়। ইতিহাস রেকর্ড রেখেছে পরের বলে কী ঘটে। বল আউটসুইং করবে ধরে জাজমেন্ট দেওয়া গ্রিনিজ বোল্ড হয়ে যান। আপাদমস্তক স্পোর্টস ফিল্ম না হয়েও কোন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ভারত দু’বার হারিয়েছিল ফিল্মটা দেখলে বোঝা যায়। প্রায় প্রত্যেকটা বল বুকের ওপর সাঁ সাঁ করে উড়ছে দেখলে বোঝা সম্ভব এখনকার জমানা কী সুযোগ ভোগ করে যে কাঁধের ওপর ডেলিভারি একটার বেশি হলে নো বল। প্রাক ১৯৮৫ সেই নিয়ম ছিল না। তাই হোল্ডিং-মার্শালরা শর্ট বল করে করে রান আটকে রাখতেন। কপিলস ডেভিলস কাপ জিতেছিল সেই কঠিনতম পুরনো নিয়মের মধ্যে। শুনলাম মার্শাল,গার্নার ,লয়েডের ছেলেদের দিয়ে এক একটা চরিত্রে অভিনয় করানো হয়েছে। সেজন্যই কি দৃশ্যগুলো এত বিশ্বাসযোগ্য যে রিল আর রিয়েল মিশে যায়? রোমি চরিত্রে দীপিকা যেমন ব্যক্তিগত জীবনে পর্দার কপিলের স্ত্রী। বললাম না ক্রমাগত দুটো ধারা মিশতে থেকে মধ্যবয়সি মননকে চূড়ান্ত নস্ট্যালজিয়ায় ফেলে দেয়।
আর হ্যাঁ ,সত্যাশ্রয়ী হতে গিয়ে কাপজয়ের পিছনে মহাতারকাদের বিবাদের ঝোড়ো বাস্তব দেখানো হবে কিনা কৌতূহলী ছিল ক্রিকেটমহল। দেখা গেল বাদ দেওয়া হয়নি। বিবাদের কারণ,সেবার একটা ম্যাচে শুধু গাভাস্করকে বাদই দেওয়া হয়নি,সেমিফাইনালের আগে টিম মিটিংয়ে কপিল তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “অনেক হয়েছে এবার টিমের জন্য কিছু তো করো।” গাভাস্কর চরম অপমানিত বোধ করেছিলেন। অনেক বুঝিয়েভাজিয়ে তাঁকে ঠান্ডা করেন ম্যানেজার মান সিং। মানের এই কূটনীতি কাজ না করলে ভেঙে পড়ত ভারতীয় ড্রেসিংরুম। টিম ম্যানেজার চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠী অতুলনীয়। ‘মির্জাপুর ২’ যেখানে শেষ করেছেন সেখান থেকেই কি শুরু করলেন ‘৮৩’? উত্তরের খোঁজ না করেই বলা যায়, কোনও টিমের ম্যানেজার এমন ব্যাট করলে তাদের হারায় কার সাধ্য?
ফিল্মের শুরুতে রিভার্স সুইপের কথা বলছিলাম। ডেথ ওভারের অনিবার্য ল্যাপ শটও রয়েছে যখন গোটা দেশের সঙ্গে মুম্বইয়ের বাড়িতে ফাইনাল দেখতে বসে দশ বছরের ফুটফুটে কোঁকড়াচুলো ছেলেটা। আর অনুপ্রাণিত হয়ে শপথ নেয় সে-ও একদিন দেশের হয়ে খেলবে। কে আর ? শচীন তেন্ডুলকার। এটাও তো সত্যি।
আসলে তিরাশির জয় হার ভারতীয় জাতীয়তাবাদেরও চিরন্তন জয়। যেখানে হিন্দু,মুসলিম,ক্রিশ্চান,শিখ সবাই একটা পতাকার জন্য লড়েছিল। ড্রেসিংরুমে কেউ জানতে চায়নি কার বর্ণ কী, ধর্ম কী,ভাষা কী? সিনেমাটিক উৎকর্ষ সমালোচকেরা বিচার করবেন। হয়তো সত্যাশ্রয়ী হতে গিয়ে নিপুণ কল্পনার মায়াজাল বুনতে যাননি কবীর খান। হয়তো আর পাঁচটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী সিনেমার মতো অস্কার গন্তব্য নয় ‘৮৩’র।
কিন্তু তাতে কী? অস্কারে যায় সব সেরা সিনেমা। জীবন কি কোনও পুরস্কারে নমিনেশন পায়? নাকি জীবন জীবনেই গভীরভাবে গেঁথে থেকে একটা সময় ইতিহাসের রাজপথে গড়িয়ে পড়ে?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.