সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: যা দেখা যাচ্ছে, সংসারে জড়িয়ে থাকা এবং সংসার থেকে দূরে থাকা-দুটোকেই সমান মর্যাদা দিচ্ছে জীবন। এই রাখা আর ছাড়ার মাঝের ফাঁকটুকুই ভরাট করছে কালীপুজোর পরের রাতের দীপাবলির আলো। সেই আলো এসে পড়ছে একেকটি আশ্চর্য গল্পে। কখনও তাতে ঝলমলিয়ে উঠছে প্রথম প্রেমের মুগ্ধতা এবং বিয়ের পর দীর্ঘ দাম্পত্যের সুখযাপন। কখনও আলো এসে পড়েছে সাধকজীবনে, উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে জীবনের চরম প্রাপ্তি মোক্ষের পথ। কখনও আবার সেই আলোকিত পথ বেয়েই ঘরে ফিরছে মানুষ, তাকে ঘিরে শুরু হচ্ছে আনন্দ উদযাপন। এই সব কিছু নিয়েই দীপাবলি। হিন্দুর দীপাবলি, জৈনর দীপাবলি, শিখের দীপাবলি, বৌদ্ধের দীপাবলি। ভারতের আলোকিত ইতিহাসের পাতা ওলটানো।
এখন, প্রদীপ জ্বালার আগে একটা প্রস্তুতিপর্ব থাকে। প্রদীপ তৈরি করার। তার পরেও কাজ অফুরান। সলতে পাকানো, তাকে তেলের আদরে রাখা। সবার শেষে আগুনের ছোঁওয়া যা আনন্দ হয়ে ধরা দেবে। এই শ্রমপর্বটুকু শুরু হল ঠিক তখন, যখন আত্মবিস্মৃত হলেন দেবতাদের রাজা ইন্দ্র। ঋষি দুর্বাসার দেওয়া দিব্য মালা হেলাফেলায় পরিয়ে দিলেন বাহনের গলায়। অতঃপর বাহনটি সেই মালা ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করতেই নেমে এল অভিশাপ- দেবলোক শ্রীহীন হবে। স্বর্গের সেই ঐশ্বর্য ফিরিয়ে আনতে শুরু হল সমুদ্র মন্থন। যা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিল এক দিব্য বিবাহের দিকে।
[ধস-আগুন থেকে রক্ষা, সিঙ্গারণ কালীর অলৌকিকতায় বিশ্বাস আজও]
প্রবাদ বলে, মন্থনের পঞ্চম দিনে সমুদ্র থেকে উথ্থিতা হন দেবী লক্ষ্মী। ওই দিন থেকেই দীপাবলির পাঁচ দিনের উৎসব শুরু হয়। অবশেষে, দীপাবলি অর্থাৎ আজকের রাতটিতে লক্ষ্মী স্বামী হিসাবে বরণ করে নেন বিষ্ণুকে। দেবতারা আলো জ্বালিয়ে মেতে ওঠেন উৎসবে। দেবতাদের সেই দীপমালার সমাহারই দীপাবলি। স্বর্গের সেই বিবাহের কথাই বলে মর্ত্যের প্রদীপের আলো। আরও বলে, বিবাহবার্ষিকীতে বিষ্ণু বাধ্য স্বামীর মতো ঘরেই থাকেন! কোথাও যান না স্ত্রীকে ছেড়ে! তাই লক্ষ্মীও প্রসন্ন মনে ঘরটিকে সাজিয়ে তোলেন প্রদীপ আর তাঁর রূপের আলোয়।
ঘরবাঁধার সূত্রে এই যে শুরু হল দীপাবলির আলোর উৎসব, তা বারে বারে ঘরে ফিরিয়ে আনছে পথিককে। রাবণবধের পরে রাজা রামও এই দিনটিতে ঘরে ফেরেন। বসেন অযোধ্যার সিংহাসনে। স্ত্রী সীতা আর ভাইদের সঙ্গে তাঁর আনন্দই কি আলো হয়ে ধরা দিল দীপাবলির উৎসবে? ভারত অন্তত তেমনটাই মনে করে। বলে, এই দিন অযোধ্যায় কারও ঘর নিষ্প্রদীপ ছিল না। আজও সেই ঘরে ফেরার গান গেয়ে যায় দীপাবলির আলো।
রাম একাই নন, দীপাবলির দিন ঘরে ফিরেছিলেন গুরু হরগোবিন্দজিও। ইতিহাস বলে, সেই সময় ভারত শাসন করছেন আকবরের পুত্র জাহাঙ্গির। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দেন শিখ ধর্মগুরু অর্জন দেবজি। আর, পিতার মৃত্যুতে বুঝতে পারেন হরগোবিন্দ- কৌমকে শক্তিশালী করতে হবে। গড়তে হবে নিবিড় করে। তাই শুরু হয় রামদাসপুর, বর্তমান অমৃতসরে দুর্গ তৈরির কাজ। সেই সঙ্গে হরগোবিন্দ স্থাপন করেন এক সাময়িক রাজত্ব- অকাল তখত। কিন্তু, তার পরিণতি সুখের হয়নি। এই উদ্যোগের কারণেই তাঁকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি করে রাখেন জাহাঙ্গির। পরে যখন তিনি বুঝতে পারেন, হরগোবিন্দ নিরপরাধ, তিনি তাঁকে মুক্তি দেন। মুক্তি পেয়ে এই দীপাবলির দিনেই রামদাসপুরে ফিরে এসেছিলেন হরগোবিন্দ। আর, শিখরা মেতে উঠেছিলেন আনন্দে। প্রদীপ জ্বালিয়ে রাতটি স্মরণীয় করে তুলেছিলেন তাঁরা। তাই শিখদের কাছে দীপাবলি বন্দি ছোড় দিবস। অমৃতসরের আলো-জ্বালা রাত।
ফিরে আসার এই গাথায় ভাগ রয়েছে বৌদ্ধদেরও। থেরাভেদা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, এই দীপাবলি তিথিতেই ত্রয়োত্রিংশ স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। তাঁর সেই প্রত্যাবর্তনের আনন্দই লুকিয়ে থাকে দীপাবলির আলোকমালায়। আবার, বজ্রযানী বৌদ্ধরা এই দীপাবলি রাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করেন চরাচর, পূজা করেন বসুধারা বা লক্ষ্মীর।
[কঙ্কালসার চেহারায় কালিকার আরাধনা বর্ধমানে]
সংসারে জুড়ে থাকার এই আলোই কিন্তু সমান ভাবে পড়েছে সংসার ছাড়ার খাতেও। সে কথা বলছে খ্রিস্টেরও জন্মের আগে তৃতীয় শতকে রচিত জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর কল্পসূত্র। কল্পসূত্র মতে, সংসার ত্যাগ করে মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের জন্য পাওয়াপুরীতে সাধনা করছিলেন শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর। এই দীপাবলির রাতেই তিনি বহু প্রার্থিত নির্বাণ লাভ করেন। যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে আলোক উৎসবের উদযাপনের মধ্যে। অর্থাৎ, জৈনদের কাছে দীপাবলি জ্ঞানের আলোর উৎসব। জৈন মত আরও বলে, মহাবীরের প্রধান শিষ্য গৌতম গান্ধার স্বামীও এই দীপাবলি তিথিতেই লাভ করেছিলেন কৈবল্য বা চূড়ান্ত জ্ঞান। দুইয়ে মিলেই জৈনদের আলোর উৎসব।
এই সব গাথা আজ জেগে উঠেছে প্রদীপের আলোয়। একটি একটি করে জ্বলে উঠছে প্রদীপ আর কোরক খুলে নতুন হয়ে উঠছে স্মৃতি। মনে হচ্ছে, এই তো সে দিনের কথা! আলোর মতোই আমাদের সঙ্গে তারা থেকে গিয়েছে। আজ শুধু বিশেষ করে ফিরে দেখা। কার্তিকের হিম, নিকষ রাতে নিয়ে আসা আলোর উত্তাপ আর আশ্বাস। প্রতি পরতে পরতে এভাবেই প্রজন্মকে জুড়ছে দীপাবলি।