দেবীশ্রী রায়: প্রবাস থেকে বলছি – ঘর ছাড়া সব প্রবাসীর দল আমরা, পরবাসে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালাই। আচ্ছা, মানুষ ঘর ছাড়ে কীসের টানে? সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষের ধর্ম একটাই – চরৈবেতি! তাই এগিয়ে চলেছি, এক স্থান থেকে আর এক স্থানে। হৃদয়ে সযত্নে গোছানো সংসার, ফেলে রেখে আসা এক চিলতে নিকানো উঠোন, এক পরম যত্নে গচ্ছিত রাখা কিছু পিছুটান। কিন্তু ঘর একদিন ছাড়লে সে ঘরে ফিরে যাওয়া হয় না আর – ঘর থেকে ঘর, ঘুরে ঘুরে বেড়াই শুধু। এমনই ভাবে, মায়ার খেলায় আমরা এসে জুটেছি সব, আমেরিকার (US) মেমফিস শহরে। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ-ইয়র্ক নয়, এমনিক হিউস্টন-ডালাসও নয়। আপামর বাঙালির পরিচিত মার্কিন মানচিত্রে মেমফিস নগরী কোনওদিনই A লিস্টে আসবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ দিকের একটি রাজ্য টেনেসি, অপরূপ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আর সেই টেনেসি রাজ্যের এক শহর হল আমাদের এই মেমফিস (Memphis) – আপন বয়সভারে কলকাতার প্রায় সমসামিয়ক। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে মিসিসিপি নদী, দেখলেই গঙ্গার কথা মনে পড়ে। সেই নদীতীরে মাথাচাড়া দিয়েছে দু-বাহু প্রসারিত কাশফুলরাশি, সেই নীল আকাশ, আর সাদা মেঘের ভেলা। আগমনী সুর কি কেবলই বঙ্গদেশে বেজে ওঠে? এক লহমায় সমস্ত টাইম ফ্র্যাব্রিকে ঢেউ তুলে বঙ্গভূমি এসে মিশে যায় মেমফিসের তীরে।
প্রবাসের জীবনে দুর্গাপুজোর (Durga Puja) ছুটি নেই। সেটাই স্বাভাবিক। ঢাকের বাদ্যি নেই, প্যান্ডেল নেই, পুজোর রেশ-গন্ধ নেই। কিন্তু প্রকৃতি অকৃপণ। এই সময় মেমফিসে গরমের ভাব কেটে গিয়ে শরৎ-হেমন্ত উঁকি দেয়। পোশাকি নাম তার Fall. সূর্যের রং সোনা ধরে, ঘাসের উপর শিশির বিন্দু জমে, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় সোনা রোদ লুকোচুরি খেলে। বাতাসে হালকা হিমেল ছোঁয়া। গাছে গাছে আগুনে রং লাগে – লাল-হলদে-সোনালি। শীতকালে সব পাতা ঝরিয়ে দেওয়ার আগে যেন শেষ সমারোহ। আর, রাত্রিবেলা কালো আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে কালপুরুষ ঝলমল করে। যেন কোহিনূর মণি।
সহস্র মাইল দূরে বসে আমার মতোই সব বাঙালির মনে এসে ধরে এক অমোঘ পিছুটান। আবহ সংগীতের মতো গ্রাস করে আগমনী। পুজো মানেই ঘুরে ফিরে আসলে এই ‘হোম কামিং’। উমা ফিরছেন পিতৃগৃহে, সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়েটা এই কদিনই ফিরবে তার মায়ের কাছে। দুর্গাপুজো ঘরে ফেরার উদযাপন। মনের ভিতরে সেই শাশ্বত হরিহর কেবলই নিশ্চিন্দিপুর ফিরে ফিরে যাচ্ছ। কিন্তু আমরা অপারগ। এ দেশে অনেক প্রাচুর্য থাকলেও ছুটির ব্যাপারে নেহাত কার্পণ্য। তাই সাত সমুদ্র পেরিয়ে শুধু পুজো বলে যাওয়ার সুযোগ কম। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে সহজেই পূজিত হন মা দুর্গা।
মেমফিস শহরে বেশ অনেক হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে ডাক্তার ছাড়াও অনেক গবেষক (Research) কাজ করেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই। তার উপর আছে ফেডেক্স বলে একটা সংস্থার হেড অফিস। স্বাভাবিকভাবেই বহু ভারতীয়র বাস এই শহরে। বাঙালিরাই বা বাদ যায় কেন? আর বাঙালি (পড়ুন বর্ণহিন্দু) আইডেন্টিটির ধারক ও বাহক হলেন মা দুর্গা (Durga)। তিনি তো শুধুই অসুরদলনী নন, চালচিত্র ছেড়ে এসে মহামায়া কবেই আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে গিয়েছে, বোধ করি ঈশ্বরী পাটনীর হাত ধরে। একদা ব্রিটিশরা তাদের ক্লাবগুলিতে নেটিভদের ব্রাত্য করেছিল। আর তার প্রতিবাদে পাড়ায় পাড়ায় বাঙালির ক্লাব প্রতিষ্ঠা। বনেদি বাড়ির উচ্চ দালান থেকে মা দুর্গা সর্বজনীন হয়েছেন এই বারোয়ারি পুজোর হাত ধরেই। তাই, বাঙালি থাকলেই পুজো হবে। মেমফিস ও তার ব্যতিক্রম নয়।
আমাদের মেমফিসের দুর্গাপুজো প্রায় ৪০ বছরের পুরনো। মিড-সাউথ বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন বলে বাঙালিদের এক ক্লাব আছে এখানে, তারাই এই দুর্গাপুজোর আয়োজন করে থাকে। ১৯৮০ সাল নাগাদ বেশ কয়েকঘর বাঙালি এক সান্ধ্য আড্ডা থেকে এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁরাই পুজো শুরু করেছিলেন। সেই ট্র্যাডিশন চলেছে। আমি ২০২১ সাল নাগাদ এই শহরে আসি। ওই বছর সুযোগ হয়নি, কিন্তু ২০২২ সালে প্রথমবার এই পুজোয় যোগদান করি। পুজোর কর্মকর্তারা কয়েকমাস আগে থেকেই শুরু করে দেন প্রস্তুতি। শুক্র-শনি-রবি জুড়ে চলে হিসেবনিকেশ, হল বুকিং, লাইট-সাউন্ড। তার মধ্যেই চলে মহড়া। পুজো মানেই পুজোর অনুদান। গান-নাচ-নাটক। রিহার্সাল মানেই আনন্দ।
এভাবেই দেখতে দেখতে পুজো এসে যায়। শুক্রবার বিকেলে থেকে শুরু হয় পুজো। দুপুর থেকেই আয়োজকরা ওই দিনটা তাঁরা কাজের জায়গায় ছুটি নিয়ে রাখেন শেষ কয়েকঘণ্টা হয়ত। দুর্গাপুজো বলে কথা – মহাপুজো। চাট্টিখানি কথা? পায়ে পায়ে এসে হাজির হন আরও অনেকেই। কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর আসার মতোই ব্যাপার, মা এখানে প্যাকিং বাক্সে সারাবছর শীতঘুমে থাকেন কারোও বাড়িতে। এই দিন সপরিবারে তাঁকে আনা হয়, চালচিত্র সমেত। মেমফিসের পুজো হয় কর্ডোভা কমিউনিটি সেন্টার বলে এক হল ঘরে।
সেখানেই শুক্রবার থেকে সাজ সাজ রব। একদল মানুষ লেগে পড়েন সাজ-সজ্জায়। ঠাকুর নিয়ে এলে উলুধ্বনি-শাঁখের আওয়াজ। বরণ করে মাকে ধরে তোলা হয়, প্যাকিং বাক্স (Packing Box) খুলে। মহিলারা ব্যস্ত কুটনো কোটায়। শনিবার দুপুরে এত মানুষের খিচুড়ি-লাবড়ার এত এত সবজি-তরকারি নিজেদের কাটতে হয়। তারপর অবশ্য নটরাজন বলে একজন দক্ষিণ ভারতীয় সব রান্না করে দেন। শুধু মহিলা নন, পুরুষরাও কেউ পিছিয়ে নেই এসব কাজে। দুপুর দুটো থেকে সবাই মিলে হাত লাগিয়ে ব্যবস্থাপনা শেষ হতে না হতেই বিকেল পাঁচটায় এসে গেলেন আমাদের পুরোহিত। শ্রী গৌতম দীর্ঘাঙ্গী মহাশয় এই মহা দায়িত্ব সামলেছিলেন। ২০২২ সালেও উনি প্রবল শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও পুজো করেছেন। কিন্তু, তারপর তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন না-ফেরার দেশ। এই বছর আমাদের পাশের শহর ন্যাশভিল থেকে বাঙালি প্রফেসর ড: অচিন্ত্য রায় আসবেন পুজোয় পৌরহিত্য করতে।
ষষ্ঠী পুজোয় শাঁখের আওয়াজ, কাঁসর-ঘণ্টা, ধুপধুনো – মুহূর্তেই যেন সব বদলে যায়। ইহ গচ্ছ, ইহা তিষ্ঠ – মন্ত্রধ্বনিতে শুরু হয় বোধন। মৃন্ময়ী মূর্তি যেন জাগ্রত হয়ে ওঠেন। ওইদিন পুজো শেষে খাওয়া-দাওয়ার পালা। লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম, মিষ্টিসহ নৈশভোজ যেন অমৃত লাগে। সেদিনের মতো সব শেষ। গাড়ি ছুটিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। পরদিন আবার সকাল সকাল তৈরি হয়ে আসতে হবে। বাক্স-প্যাঁটরা খুলে বেরয় সব শাড়ি-জামা। সবাই জমিয়ে রাখেন তাঁদের নতুন নতুন শাড়ি, গয়না। এদেশে তো এমনিতে এসব পরা হয় না। পুজোর দিন তাই সবাই সুযোগের সদব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না কেউ। সপ্তমী-অষ্টমী পুজোয় ক্রমে ভিড় বাড়ে। বাচ্চাদের দৌড়-ঝাঁপ। গোল গোল আড্ডা, তার মধ্যে চলে পলিটিক্যাল আলোচনা – কখনও এদেশের পলিটিক্স, কখনও ওদেশের। সবার মনে তখন ফেলে আসা পুজোর স্মৃতি আড্ডা ভিড় করে।
ততক্ষণে নবপত্রিকা স্নান হয়ে অধিবাসের পুজো চলছে। তার পর অষ্টমী পুজো। পুষ্পাঞ্জলির পালা। এতক্ষণে ভিড় বেড়ে জমজমাট। দূর-দূরান্ত থেকে কত মানুষ শাড়ি-পাঞ্জাবিতে সেজে এসেছেন, শুধু একটুখানি পুজোর স্বাদ আস্বাদন করবেন বলে। দু-একজন উৎসাহী মানুষ আবার স্টলও দিয়েছেন, মেলার মতো। শাড়ি-কুর্তি-গয়না বিক্রি হচ্ছে। বেশ এক আনন্দধারা বইছে যেন। শুরু হয় অঞ্জলি। শোনা যায় সেই মহা-মূল্যবান, আদি অকৃত্রিম প্রশ্ন, ‘সবাই ফুল পেয়েছেন?’ অঞ্জলি শেষে ভাগ হয়ে হোমাগ্নি জ্বলে ওঠে। খিচুড়ি-লাবড়ায় ভোগ-প্রসাদের মধ্যে দিনটা শেষ হয়।
আবার সেজেগুজে বিকেলবেলা হাজির। সন্ধ্যারতির পাট চুকলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (Cultural Programme)। মেমফিস ছোট জায়গা। তাই বড় বড় পুজোর মতো কোনও বিখ্যাত আর্টিস্ট আসেন না কলকাতা (Kolkata)থেকে এখানে। পুজোর অনুষ্ঠানও নিজেদের মধ্যে। বাংলা গান, বাংলা নাটক – এদেশে বসেই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা নিজেদের ঐতিহ্য। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কিছু। কত চেষ্টা করে বাবা-মা এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বসেও বাচ্চাদের সুকুমার রায় শেখাচ্ছেন, কিংবা রবি ঠাকুরকে চেনাচ্ছেন, দেখলে চোখে জল আসে। অনভ্যস্ত, কচি গলায় ‘আমরা সবাই রাজা’ উচ্চারিত হলে আরও একবার বাংলা ভাষার জয় হয়। এরপর খাওয়াদাওয়া। বাঙালির পুজোর ভোজে মুরগি-মটন না থাকলে কি আর জমে? জমিয়ে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে সে রাতের মতো সমাপ্ত।
আবার পরদিন। নবমী নিশিতে উইকেন্ড শেষ, পুজোও। সন্ধিপুজোর আলোয় মায়ের মুখ প্রজ্জ্বলিত হয়। ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর গন্ধ। দর্পণে বিসর্জন। মায়ের চোখেও যেন জল। দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে শুরু মাতৃবরণ। সিঁদুর পরিয়ে দেওয়া একে অন্যকে। অনেকে শ্বেতাঙ্গিনী আসেন, মাকে বরণ করবেন বলে। শিখে নেন তিনি তাঁর শ্বশুরবাড়ি ‘কালচার’; পান পাতা দিয়ে কীভাবে মায়ের মুখ মুছিয়ে দিতে হয়, কানে কানে বলেত হয় ‘আবার এসো মা’। কোলাকুলি সেরে সিঁদুরখেলা। অক্ষয় হোক সকলের সিঁথির সিঁদুর।
শুনে এসেছি, কোনও একস্থানে ১২ বছর পুজো হলে, স্থান মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভগবান সেই স্থানে বিরাজ করেন। মেমফিসে আজ ৪০ বছর ধরে মা পূজিত হচ্ছেন। মা এখানেই বিদ্যমান। হয়তো দিনক্ষণ মেনে পুজো হয় না, ব্যবস্থাপনাতেও থেকে যায় ত্রুটি। তবু মন্ত্রহীনম, ক্রিয়াহীনম আমরা, তবু আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে চলে এই পুজো – বছর-বছর। বিসর্জন হয়না মায়ের এখানে। আবার প্যাকিং বাক্সে ভরে শায়িত থাকেন। এক বছরের অপেক্ষা আবার। পুজো শেষে কমিউনিটি সেন্টার নিজেদের পরিষ্কার করে দিয়ে যেতে হয়। এত পরিশ্রম শেষে রবিবার বাড়ি ফেরার পথে বিজয়ার শুভেচ্ছা সবার মুখে। আর একটাই স্লোগান – ‘আসছে বছর আবার হবে।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.