দীপঙ্কর মণ্ডল: দারিদ্র স্কুলছুট করেছিল। ভাল ফুটবল খেলত। পড়াশোনায়ও মন্দ ছিল না। কিন্তু পরিবারের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য চা বাগানের কাজে লেগে পড়েছিল জন নামের ছোট ছেলেটা। জলপাইগুড়ির লখিমপাড়া চা বাগানের অন্য আদিবাসী ছেলেদের মত শ্রমিকের পেশায় যুক্ত হয়েছিল সে। আর এবারের লোকসভা ভোটে আলিপুরদুয়ারের বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন জন বারলা৷
জনের বয়স এখন তেতাল্লিশ। নাগরাকাটা বিধানসভা এলাকার চা বাগানে বড় হয়েছেন। স্থানীয় বীরপাড়া হিন্দি হাই স্কুলে পড়তেন। পারিবারিক অভাবের কারণে মাধ্যমিক দেওয়া হয়নি। তবে, চা বাগানের শ্রমিক থেকে রাজনীতির দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছনোর জার্নিটা কিন্তু চমকপ্রদ৷ শ্রমিক থেকে শ্রমিক নেতা৷ ট্রেড ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ পদ৷ সেখান থেকে ধীরে ধীরে গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং ২০১৯ লোকসভা ভোটের প্রার্থী হওয়া৷ সংগ্রাম তাঁর আজীবনের সঙ্গী৷ লড়াই তাঁর রক্তে৷ তাই লম্বা সময় ধরে জন বারলা মাটি কামড়ে থেকে লড়েছেন৷ এবার লড়াই দিল্লির পথে৷
[ আরও পড়ুন : নির্বাচনী ম্যাসকট ভোট্টুর সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক বর্ধমানে]
কোচবিহারের তুফানগঞ্জ, জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা এবং আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রাম, কালচিনি আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা ও মাদারিহাট – এই সাতটি বিধানসভা মিলিয়ে আলিপুরদুয়ার তফসিলি উপজাতি সংরক্ষিত লোকসভা কেন্দ্র। ভোটার সংখ্যা ১৬ লক্ষ ৪২ হাজার ২৮৫ জন। লড়াই মূলত দ্বিমুখী৷ তৃণমূল প্রার্থী দশরথ তিরকে আর বিজেপির জন বারলা৷ নথি বলছে, গত পঞ্চায়েত ভোটে নিজের বুথেই হেরেছেন দশরথ। পরপর তিনবার আরএসপির টিকিটে কুমারগ্রাম থেকে তিনি বিধায়ক হয়েছিলেন। ২০১৪ লোকসভার আগে তৃণমূলে যোগ দেন। নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে দিল্লি পাঠায় দল।স্থানীয়দের অভিযোগ, সাংসদ হওয়ার পর থেকে এলাকায় খুব বেশি দেখা যায়নি দশরথকে। এবার তাই আলিপুরদুয়ার জুড়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। এর সঙ্গে আছে জন বারলার প্রবল জনপ্রিয়তা।
ফুটবলার হিসেবে তাঁর পরিচিতি। আদিবাসী বিকাশ পরিষদের নেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সুপ্রিমো বিমল গুরুংয়ের বন্ধু হিসেবেও তিনি একসময় পরিচিত ছিলেন। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে শ্রমিক নেতা হিসেবে বারলার জনপ্রিয়তা। এখনও চা বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন জন। চা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের নেতাও তিনি। বাড়িতে স্ত্রী মহিমা কুল্লা কিডনির অসুখে ভুগছেন। ছেলে জর্ডন একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। আর পাঁচটা বাহুল্যবর্জিত আদিবাসী বাড়ির মতই জীবনযাপন করেন জন। ১১ এপ্রিল এখানে ভোট৷ হাতে আর একটা সপ্তাহ৷ মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ টিগ্গা ও স্থানীয় পুষ্পরাজ বামন, ওম প্রকাশ-সহ কয়েকশো কর্মী সমর্থক নিয়ে আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রটি চষে ফেলছেন এই তিনি। মনোনয়ন পেশের দিন তাঁকে ভালোবেসে কমলা,সবুজ পাগড়ি পরিয়েছিলেন এক সমর্থক পরিয়েছিলেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পাগড়িটিই তাঁর পোশাকের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে৷
[ আরও পড়ুন : ভোট ময়দানেও দারুণ কিক! নম্র ব্যবহারে মন জয় বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবের]
এবার এই লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মোট আটজন। তার মধ্যে জনই একমাত্র চা বাগানের শ্রমিক। রাজ্যে এমন নজির মেলা ভার। উত্তরবঙ্গে এখন নিয়ম করে বিকেলের পর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝেই শ্রমিক মহল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন জন। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, নেপালি ভাষায় কথা বলতে পারেন। নিজে শ্রমিক হওয়ায় তিনি অ্যাডভান্টেজে। সবার মাঝে গিয়ে বলছেন, ‘আমি তোমাদের লোক’। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বাজপেয়ীর সুর যেমন শোনা গিয়েছে নরেন্দ্র মোদির গলায়, তেমনই শোনা যাচ্ছে জন বারলার কণ্ঠেও৷ কথায় সামান্য বদল করে তিনি বলছেন, ‘মুঝে সৌগন্ধ হ্যায় ইস মিট্টি কি, আদিবাসীও কো ঝুকনে না দুঙ্গা।’ তিনি ঝুঁকবেন না, ঝুঁকতে দেবেনও না৷