পলাশ পাত্র, তেহট্ট: ভোট আসে ভোট যায়। ওদের জীবনের কোনও পরিবর্তন নেই। সীমান্তে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কাঁটাতারকে কেন্দ্র করে ওরা যেন খাঁচাবন্দি। সীমান্তে সেনা-লস্করের খাকি পোশাক, বন্দুক, চোখরাঙানি নিয়েই কাঁটাতারের পারে ওদের জীবন। ওদের ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড, সবই রয়েছে। ভারতীয় নাগরিক হয়ে আজও ওরা পরাধীন। অনেক কিছুতে ‘না’-এর পরও গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব থেকে ওরা মুখ ফেরায় না। এই উৎসবের স্বাদও নেয় চেটেপুটে। কথা হচ্ছে নদিয়ার সীমান্ত এলাকার চরমেঘনা গ্রামের।
ভোটকে কেন্দ্র করে হিংসা যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন এখানকার সব রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের মঙ্গলবার একসঙ্গে খিচুড়ি, সবজি, পাপড় খাওয়ার দৃশ্য নিঃসন্দেহে নজর কাড়ে। চরমেঘনা গ্রামটি করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়লেও লোকসভা কেন্দ্র মুর্শিদাবাদ। এক হাজারের বেশি মানুষের বাস এই গ্রামে। সকলেই হিন্দু। ২০৪ নং বুথের এই গ্রামে ভোটার রয়েছেন ৫৫৪ জন। চরমেঘনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দেন গ্রামবাসীরা। গ্রামে একটি অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টারও রয়েছে।
[আরও পড়ুন: উন্নয়নের পরও লোকসভা ভোটে প্রচার নেই এই গ্রামে, কারণটা জানেন?]
দু’শো বছর আগে বিহার, ছোটনাগপুর থেকে আসা কাঁটাতারের ওপারের চরমেঘনাবাসীর পূর্বপুরুষরা এখানে নীল চাষের জন্য এসেছিলেন। পরবর্তীকালে এই গোটা হিন্দু গ্রামটার বাসিন্দারা কৃষিকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন। ধান, পাট, রবিশস্য বা সবজি চাষের উপর এখানকার মানুষ নির্ভরশীল। তাদের সন্তানসন্ততি এবং বর্তমান প্রজন্ম এখন পড়াশোনা করে শিক্ষিত হচ্ছে। কলেজে যাচ্ছে। দু-একটি ঘর থেকে তো সরকারি চাকরিজীবীও পাওয়া যাবে। কিন্তু সকাল থেকে বিকেল ছ’টা পর্যন্ত গেট খোলার পর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নাগরিক জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। এই সময় ভোটার কার্ড বা পরিচয়পত্র গেটে দেখিয়ে চাষবাস ও অন্যান্য কাজ সারতে হয়। বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বা বিবাহিত মেয়ের বাপের বাড়িতে থাকা কিংবা রাত-বিরেতে প্রসূতি মায়েদের নিয়ে ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হয়।
এছাড়া ওপারে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের চুরি,ডাকাতির সমস্যাও রয়েছে। মাথাভাঙা নদী ও সীমান্তের আন্তর্জাতিক নিয়ম কাঁটাতারের ওপারে ফেলে দেয় চরমেঘনাকে। হোগলবেড়িয়া থানার চরমেঘনার স্টেটাস ছিটমহলের মধ্যে পড়ে না৷ সরকারিভাবে অ্যাডভার্স পজেশান ল্যান্ড। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাইয়ের পর চরমেঘনা ভারতের ভূখণ্ডে চলে আসে। তাতে অবশ্য নাগরিক পরিষেবা পেতে সুবিধা হয়। এখন পঞ্চায়েত পরিষেবাও মেলে চরমেঘনায়৷ বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, ইন্দিরা আবাস যোজনা, পাকা রাস্তা পাচ্ছেন গ্রামবাসীরা। তবে প্রশাসনের অনুমতি না মেলায় চরমেঘনায় দুর্গাপুজো হয় না। যা গ্রামবাসীদের মন খারাপের কারণ।
[আরও পড়ুন: নিখোঁজ রহস্য উদ্ঘাটনে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি নোডাল অফিসারের স্ত্রীর]
এদিন ভোটে গ্রামে কোনও রং লাগেনি। গেরুয়া, লাল, সবুজ রং নিয়ে কোনও ঝামেলাও নেই এখানে। মিঠুন বিশ্বাস, বুদ্ধদেব মণ্ডল, ফিলিপ মণ্ডল, রাজু মণ্ডলরা শুধু চান, যে দলই জিতুক, গ্রামে উন্নতি হোক। কারণ, গ্রামে ভোট এলেই নেতারা আসেন। হাজার প্রতিশ্রুতি দেন। ভোট মিটতেই সব ভ্যানিশ। চরমেঘনাবাসীর কোনও পরিবর্তন হয় না। এই নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি থেকে কাঁটাতারের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া নিয়ে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।