Advertisement
Advertisement
ভুটান, জয়গাঁ

নির্বাচন যেন পৌষমাস, ভারত-ভুটান সীমান্তে বেআইনি নোটের রমরমা কারবার

দিনে লাখ বিশেক ভুটানি মুদ্রা বদলে যায় ভারতীয় টাকায়।

The value of Bhutanese currency has increased during election phase
Published by: Bishakha Pal
  • Posted:April 7, 2019 9:38 am
  • Updated:April 7, 2019 9:43 am

কলহার মুখোপাধ্যায়, জয়গাঁ: যদি বলি জয়গাঁ গিয়েছিলাম, চিনতে পারবেন? অসুবিধা হচ্ছে তো? কিন্তু যদি বলি ‘ফুন্টসোলিং’ গিয়েছিলাম? নিশ্চয়ই চিনতে আর অসুবিধা হচ্ছে না। বাঙালির কাছে এই নামটা বেজায় চেনা। একশোর মধ্যে পঞ্চাশ জনই বলে দিতে পারবেন। তাঁদের বক্তব্য হবে খানিক এইরকম- ওহ্‌! ভুটানে গিয়েছিলেন, তা-ই বলুন! জানিয়ে দিই, ভুটানের ফুন্টসোলিং থেকে পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের জয়গাঁতে পায়ে হেঁটে আসতে মেরেকেটে লাগবে ৩০ সেকেন্ড।

দেশের ওপারে ভুটান। ছবির মতো ঝাঁ-চকচকে শহর। এপারে বাংলার প্রত্যন্ত একটি গঞ্জ। ওপারে ঝকঝকে, কেতাদার সব মানুষ। এপারে ছাপোষা চেহারা, অবিকল আপনার-আমার মতো। দু’পারের কোনও মিল নেই। ভুল বলা হল। মিল শুধু একটি জায়গাতে। দু’পাশেই চলছে দু’দেশের নোট। জয়গাঁতে ভারতীয় টাকা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ভুটানের কারেন্সির দস্তুরমতো রমরমা। নির্বাচনের বাজারে যা আরও বেড়েছে। ওপারেও একই ব্যাপার৷ 

Advertisement

                                           [ আরও পড়ুন: ভোটের আগেই ফল ঘোষণা! প্রচারে অনুব্রত মণ্ডলের মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক]

‘ইন্ডিয়ান রুপি’ বা ছোট করে বললে ‘আই এন আর’। তেমন ভুটানের কারেন্সিকে ছোট করে বলে ‘বিটিএন’। ইংরেজিতে বলে Bhutanese Ngultrum। ভারতের ৯৯৮ টাকা ২০ পয়সা দিলে ভুটানে মিলবে ১০০০ টাকা। মানে ১০ হাজার ভুটানি টাকা দিলে ভারতে ১৮ টাকার মতো লাভ। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে দুই বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে, শুধুমাত্র জয়গাঁ দিয়ে এবং পুরোটাই বেআইনিভাবে। তবে ভুটানের বা ভারতের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তেমন লাভ হচ্ছে না। কারণ, আগের তুলনায় দর বেড়েছে ভুটানের নোটের। অনেকে নোট বদল করছেন কমিশনে গিয়ে। স্থানীয় ভাষায় এই ব্যবসাকে ‘বাট্টা’ বলে। একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এই বেআইনি কাজ করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরেই। আগে এর বাড়বাড়ন্ত আরও বেশি ছিল। তখন আলিপুরদুয়ার সদর পর্যন্ত নির্দ্বিধায় চলত বিটিএন। এখন তা বন্ধ হয়েছে। এখন ১২ কিলোমিটার দূর হাসিমারা পর্যন্ত এই টাকার চল রয়েছে। আর একটু দূরে কালচিনির কোথাও কোথাও ভুটানি নোট চলে।

Advertisement

এসব দেখতে কীভাবে যাওয়া যাবে জয়গাঁ? উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের একটি শহর এটি। আলিপুরদুয়ার সদর থেকে ৬২ কিলোমিটার। বাস যায়। অটো, টোটো, ম্যাজিক গাড়িতেও ব্রেক জার্নি করা যায়। নিজের গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই। অটোতে বক্সা রিজার ফরেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কালচিনি পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার গেলে পড়বে হাসিমারা। সেখান থেকে আবার ম্যাজিক গাড়িতে ৭ কিলোমিটার গেলে জয়গাঁ। তোর্সা চা-বাগানে তখন মহিলা শ্রমিকরা কাজ করছেন। হঠাৎ দেখা যাবে একেবারে মাটি ফুঁড়ে একটা পাহাড় চোখের সামনে উঠে এসেছে। দেখামাত্র বুঝতে হবে জয়গাঁতে পা রেখেছেন। এরপর বিভিন্ন ধরনের গাড়ির লম্বা জ্যাম।

[ আরও পড়ুন: রাজকুমারের পুনরাবৃত্তি চান না কেউ, কেন্দ্রীয় বাহিনী না পেলে ভোট বয়কট ]

মেরেকেটে পৌনে তিন কিমি লম্বা শহর জয়গাঁ। আড়ে দু’-কিমির মতো। দিনভর রাস্তা জুড়ে জ্যাম লেগেই থাকে। স্থানীয়রা বলেন, ভুটানে যেতে শর্টকাট নেয় সব গাড়ি, ফলে অতিরিক্ত গাড়ির জন্য সর্বদা যানজট লেগে থাকে। এর পুরোটা ঠিক নয়। স্থানীয় গাড়ির চাপও রয়েছে। বন্ধ চা-বাগানগুলির শ্রমিকরা ভুটানে যান রাজমিস্ত্রির কাজ করতে। স্থানীয় প্রশাসনের একটি হিসাব বলছে, প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ভুটানে কর্মসূত্রে যান। বিকেলে ফেরত আসেন। তাঁদের বাড়ি নিয়ে যেতে ও ফেরাতে স্থানীয় গাড়ির সংখ্যাও প্রচুর বেড়েছে। ফলে যানযটের সমস্যা নিত্যদিনের ঝঞ্ঝাট।

জয়গাঁতে কী নেই? ফুন্টসোলিং বর্ডারের ধার ঘেঁষে ইলেকট্রনিকের বিশাল মার্কেট। জায়গাটাকে বলে ‘জেএমডি রোড’। তার বাইরে উঁচু উঁচু বহুতল। তার প্রত্যেকটির তলায় মার্কেট। ব্র‌্যান্ডেড থেকে লোকাল জামাকাপড়ের সম্ভার। মায় বুদ্ধমূর্তিরও কয়েকটি বিশাল দোকান। ব্যাগ, জুতো, কসমেটিক্স, খাবারদাবার (দীপক সাহার মোমোর দোকান রয়েছে, সেখানে ১০ পিস ভেজ মোমোর দাম ২০ টাকা- অপূর্ব খেতে!) সব মিলবে। আর ভুটানে রয়েছে অপর্যাপ্ত মদ। দাম অবিশ্বাস্য কম! চোখে না-দেখলে, কানে না-শুনলে বিশ্বাসই হবে না। অফুরন্ত ওয়াইন রয়েছে। যার মধ্যে পিচ ওয়াইন না-টেস্ট করলে না কি জন্মানোই বৃথা! ফুন্টসোলিং- যার কেতাবি নাম ‘ফুয়েন্টশোলিং’ সেখানে রাস্তার রেস্তোরাঁতেও মিলবে রোস্টেড পিগ রিভস। দু’-দেশের এই দুই বাজারে চলে নিত্য লেনদেন। কমদামে জিনিস কিনতে এপারে আসেন জিন্‌স, টি-শার্ট, জ্যাকেটের কেতাদার ভুটানিরা। আর সস্তায় রোজ খাটতে ওপারে যান আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা। আর যান ব্যবসায়ীরা। সস্তার মদ কিনে এপারে বেশি দামে ছড়িয়ে দিতে। এক-দু’বোতল আনলে সমস্ত সীমা সুরক্ষা বল আপত্তি করেন না। আর এভাবে দুই বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে ওঠে ব্যবসা। জয়গাঁসহ আলিপুরদুয়ারের একাংশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ যার উপর নির্ভরশীল।

[ আরও পড়ুন: স্লোগান নয়, অভিষেকের প্রচার মিছিলে সুর তুলছে লোকগান ]

এ তো গেল ব্যবসার কথা। আর যাদের কথা নিয়ে লেখা শুরু হয়েছিল, সেই বাট্টার কারবারিদের ব্যবসা কেমন চলে? স্বাভাবিকভাবেই নাম জানাতে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানালেন, দিনান্তে গড়ে লাখ বিশেক বিদেশি মুদ্রাকে ভারতীয় মুদ্রায় বদলে দেন তিনি। নিউ ইয়ারের মরশুমে সেটি ৫০ লক্ষ ছুঁয়ে যায়। হিসাব করে দেখুন, রোজ টাকা বদলে কত টাকা রোজগার করেন তিনি। এরকম জনা তিরিশেক ব্যবসায়ী রয়েছেন জয়গাঁ জুড়ে। স্থানীয়রা এঁদের ‘প্রভাবশালী’ হিসাবেই খাতির করেন। স্থানীয় স্তরে এঁরাই ভোট নিয়ন্তা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ