Advertisement
Advertisement

Breaking News

দ্বিজেনবাবু মানেই মহালয়ার গান থেকে মাইকেলের সনেট…

‘যদি চাহ যেও ভুলে।’

Homage to Dwijen Mukherjee
Published by: Saroj Darbar
  • Posted:December 24, 2018 2:58 pm
  • Updated:December 24, 2018 4:22 pm

সরোজ দরবার: জাগো, তুমি জাগো… তাঁর জলদ কণ্ঠে যখন এ সুর ছড়িয়ে পড়ে, শারদাকাশে তখন ফুটে ওঠে পুজোর ভোর। অন্তত কয়েক দশক ধরে বাঙালির পুজোর নান্দীমুখের এটাই রীতি। আবার শরৎ আসবে, পুজোর ঢাকে কাঠি পড়বে। কিন্তু কালের নিয়মেই আর জেগে উঠবেন না দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। ফুসফুসের সংক্রমণে প্রয়াত হলেন বাংলার কিংবদন্তি শিল্পী।

দ্বিজেনবাবুর এই প্রয়াণ আসলে সর্বার্থে একজন আধুনিক শিল্পীর প্রস্থান। সলিল চৌধুরীর মতো সঙ্গীতের গবেষক নানা নিরীক্ষার প্রয়োজনে যাঁর কন্ঠ, গায়ন ও শিক্ষাকে আশ্রয় করেছিলেন। কণ্ঠ তো ঐশ্বর্যের বটেই। অমন ভরাট, আবেগের রং ফুটিয়ে তোলা কণ্ঠ সচরাচর মেলে কই! তুলনা টানতে হলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম উঠে আসা স্বাভাবিক। নিজের কণ্ঠকে ঈশ্বরের দান বলেই ভাবতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বারবার সে কথা বলেও গিয়েছেন। আর যে কণ্ঠটিকে বাঙালি শ্রোতা অনবধানবশত কখনও হেমন্তবাবুর বলে ভুল করে ফেলেছেন, তা অদ্বিতীয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের। আর যে গানে এই ভুল হত, সেটি অবিস্মরণীয় ‘শ্যামল বরণী ওগো কন্যা’। এ গানের মধ্যে যে রোম্যান্টিকতা আছে, ভরাট কণ্ঠের মাদকতায় সে জাদু তুলে ধরেছিলেন দ্বিজেনবাবু। তবু এই ‘ভুল হয়ে যাওয়া’ ভুল কিছু নয়। কারণ এ ‘ভুল’ বাঙালি শ্রোতার গানের ভেলাটিকেই চিনিয়ে দেয়।

Advertisement

আসলে ’৪৯ সাল নাগাদ মুক্তি পেয়েছিল সলিল-হেমন্ত জুটির ‘গাঁয়ের বঁধু’। তখনও মাইকের গানে আলাদা করে চেনা যেত পুজোকে। হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল সে গান। পুজোর গানের একের পর এক সোনালি ফসলে তখন বাংলা গানের তরী নিত্যনতুন বৈচিত্রে ভরে উঠছে। ’৫১-য় এল ওই জুটিরই অবিস্মরণীয় ‘রানার’। সেই রেশ শ্রোতার কানে থেকে গিয়েছিল। পরের বছর যখন সলিল-দ্বিজেন জুটিতে ‘শ্যামল বরণী’ এল, তখন অনেকেই হেমন্ত বলে কণ্ঠটিকে ভুল করেছিলেন। বা পরে রেডিওতে শুনতে শুনতেও সে ভুল হয়েছে। তবে ভুল তো ভুলই। বাঙালি অবশ্য অচিরেই সোনা রোদে কুয়াশা কাটার মতোই সে ভুলের মায়াজাল কাটিয়ে চিনে নিয়েছিল স্বর্ণকণ্ঠটিকে। উচ্চারণের স্বাতন্ত্রে আর কণ্ঠের ঐশ্বর্যে বাঙালি শ্রোতাকে এরপর দীর্ঘদিন মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

 কবিতাকে গান করে তোলার যে নীরিক্ষায় রত হয়েছিলেন সলিল চৌধুরি, তা অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিল সুকান্ত ভট্টাচার্য বা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ক্ষেত্রে। তবে ‘রানার’, ‘পালকির গান’ ছাড়িয়ে আরও শক্ত কবিতায় সুরের আঙুল ছুঁইয়েছিলেন সলিল। তুলে নিয়েছিলেন মধুসূদন দত্তের সনেট। ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ এবং ‘আশার ছলনে ভুলি’- এ দুটো কবিতায় সুরারোপ করেছিলেন। সেই নিরীক্ষায় কণ্ঠ দিয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। তুলনায় অল্পশ্রুত, কিন্তু এ গান যে বাংলা গানের ইতিহাসের পৃথক অধ্যায়, তা ভাবীকাল স্বীকার করে নিয়েছে।

‘জাগো দুর্গা’-র ওই ভোর ফোটানো নির্মল, স্নিগ্ধ এবং শুদ্ধ স্বর যেমন শ্রোতারা স্মৃতির সিন্দুকে তুলে রেখে দেবেন আজীবন, তেমনই নিবিষ্ট শ্রোতার কানে নিশ্চয়ই বেজে উঠবে তাঁর ‘ওগো কৃষ্ণচূড়া’। অনল চট্টপাধ্যায়ের কথায়, সে গানে সুর করেছিলেন শ্যামল মিত্র। কৃষ্ণচূড়ার ছায়াতলে দাঁড়ানো সেই যুবকটির গলায় যে প্রেম-প্যাথোস আর দরদ, তা বাঙালি ভোলে কী করে! কিংবা ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছ’ গানে ওই দ্রুত লয়ের চঞ্চলতা যেভাবে তিনি কণ্ঠে ধরেছিলেন, আজও তা প্রেমের অথৈ ঝিলে মনকে মাছরাঙা করে তুলতে পারে বৈকি। বা যদি মনে করি ‘হাওয়া এসে খোঁপাটি যে দিয়ে গেল খুলে…’ গানটর কথা। ছয়ের দশকের এ গান আজও কোনও সদ্য প্রেমিক শুনলে বুঝবেন, এরকম একটি অনন্য ও ক্ষণিকের মুহূর্ত কী নান্দনিকতায় কথায়-সুরে-কণ্ঠে বন্দি করে রাখা যেতে পারে। বিশেষত, ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটার পংক্তিতে যখন তিনি কণ্ঠ ভাসিয়ে দেন, তখন আক্ষরিক অর্থেই যেন মনের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে এক ঝলমলে নায়িকার মুখ। দ্বিজেনবাবুর ওই অনবদ্য গায়নই সেখানে তুলির টান। হিন্দি ছবিতে তাঁর প্লে-ব্যাক, কিংবা তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নিশ্চয়ই আলাদা করে কথা হবে। মহিষাসুরমর্দিনীর গান তাঁকে প্রতিবার নয়া প্রজন্মের সামনে আলাদা করে পরিচিত দেবে। তবে ওই ভরাট কণ্ঠের মাদকতা আর কারিকুরি, শিল্পী জীবনের অনবদ্য সব শৈলী যদি দ্বিজেনবাবু কোথাও রেখে যান, তবে সন্দেহাতীতভাবে তা আধুনিক গানেই। ‘পল্লিবিনী গো সঞ্চারিণী’ শুনলে আজও তো মনে হয় সুরে-যন্ত্রানুসঙ্গে এবং গায়নে এমন সর্বার্থে আধুনিক একটি গান বাংলা গানে আর দ্বিতীয়টি নেই। ফলে মন না দিয়ে আর উপায় কী!

শ্রোতাদের ভালবাসা পেয়েছেন। রাজ্য সরকারের তরফেও বহু সম্মান পেয়েছেন। রাজনীতির মঞ্চে অরাজনৈতিক হয়ে থাকা সহজ নয়। আইপিটি-এর সঙ্গে যোগাযোগই সলিল চৌধুরির কাছে এনেছিল তাঁকে। গানের পাশপাশি রাজনৈতিক সচেতনতাও হয়তো সযত্নে লালন করতেন। জীবনের শেষ পর্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তবে বয়স এবং স্বভাব গাম্ভীর্যে প্রতক্ষ্য রাজনীতি এড়িয়ে নিজের চারপাশে ওই অরাজনৈতিক বলয়টি তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাই আর কিছু নয়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় মানে ফিরে ফিরে আসবে তাঁর গানের কথাই। মৃত্যর পরই শিল্পীর নবজন্ম। সেখানে যদি গানে গানে থেকে যান, তবে তার থেকে বড় পাওনা আর কিছু হয় না। দ্বিজেনবাবু নিজে হয়তো জানতেনই, তাঁর গানের স্বরলিপি খাতায় লেখা না-হোক, শ্রোতার হৃদয়ে লেখা হয়ে ছিল এবং থাকবেও।

সলিল চৌধুরির কথা-সুরেই সেই ’৬৩ সালে গেয়েছিলেন, ‘মনে মনে হয়তো কিছুদিন ডাকবে/কিছু কিছু গান মোর মনেতে রাখবে।’ ঘর শূন্য করে, বাঁধন ছিন্ন করে যাওয়ার সে ক্ষণে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি চাহ যেও ভুলে।’  

রিক্ততার সে মুহূর্ত এল অমোঘ নিয়মেই। তবে বাংলা আধুনিক গান যতদিন থাকবে, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি শ্রোতা ভুলবে না। ভুলতে চাইবেও না।      

 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ