সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়: কিছুদিন আগে জ্ঞানমঞ্চে পরিবেশিত হল কালিনগর নান্দনিক প্রযোজিত নাটক ‘সুরমা’। নাটক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। নির্দেশনায় প্রসেনজিৎ বর্ধন। বর্তমান সময়ে সামাজিক অবক্ষয় এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে এই নাটক। মানুষের উচ্চাকাঙ্খা, অর্থের পিছনে অন্ধের মতো ছুটে বেড়ানো এবং কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজেকে যেকোনও স্তরে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া সাফল্যের এই আপাত সহজ সংজ্ঞা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে কীভাবে তছনছ করে দিচ্ছে সেটাই নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন।
প্রোমোটার এবং কন্ট্রাকটর মোহিতের সঙ্গে বিয়ে হয় প্রত্যন্ত গ্রামের সহায় সম্বলহীন ব্রাহ্মণ পরিবারের ছোট মেয়ে সুরমার। গ্রামের প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা সুরমা মোহিতকে বিয়ে করে এক কল্পনাতীত বৈভবের মধ্যে এসে পড়ে। সুরমার গ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রার সঙ্গে এই অভিজাত সমাজের মেকি শহুরে আদবকায়দার আকাশছোঁয়া ফারাক সুরমার বৈবাহিক জীবনকে ক্রমশ বিষিয়ে তোলে। মোহিত প্রায় একরকম জোর করেই সুরমাকে এই নাগরিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করতে চায়। বস্তি উচ্ছেদ করে সেখানে আবাসন বানানোর উদ্দেশ্যে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ধাঁধিয়ে দেওয়া, গরিব মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করতে থাকে মোহিত। তা দেখে সুরমা ক্রমশ মানসিক ভারসম্য হারিয়ে ফেলতে থাকে। এরপর মোহিতের ভাই মৃগাঙ্কের সঙ্গে মোহিতের আদর্শ ও দর্শনগত বিরোধ সামনে আসে। মূলত বস্তি উচ্ছেদ এবং একটা পুকুর বোজানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা চরিত্রগুলো উন্মোচিত হতে থাকে পরতে পরতে।
[ আরও পড়ুন: সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, নিউ জার্সিতে পাড়ি বাংলা-হিন্দি-মারাঠি নাটকের ]
মোহিতের ভূমিকায় দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং নাম ভূমিকায় সোমা রায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন। গ্রাম্য পরিবেশ থেকে প্রাচূর্যের মধ্যে এসে সুরমার সঙ্কোচ দ্বিধা এবং হীনমন্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি অপূর্ব দক্ষতায়। মোহিতের কর্মচারী উকিল চন্দনের ভূমিকায় রয়েছেন স্বয়ং নির্দেশক প্রসেনজিৎ বর্ধন। প্রসেনজিৎ এই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য প্রতিভাবান অভিনেতা যাঁর অভিনয়ে কোনও তথাকথিত ম্যানারিজম নেই। অন্নদাতা প্রভুর অনবরত গালমন্দ খেতে থাকা চন্দনের মুখ দেখতে দেখতে কবীর সুমনের একটা গান মনে পড়ে যাচ্ছিল- ‘থলি হাতে ঘোরে লোকে অলিতে গলিতে / জীবন আসলে বাঁধা পাকস্থলীতে।’
মোহিত যখন চন্দনের মেয়ের দেওয়া লিস্টটা ছিঁড়ে উড়িয়ে দিচ্ছে চন্দনের মুখের উপর তখন চন্দনের অসহায় হাসিটা অনেকদিন মনে থাকবে। তপনের ভূমিকায় সুদীপ্ত সাহা বেশ সাবলীল। মফঃস্বল থেকে আসা চরিত্রের সঙ্কোচ, প্রতিপদে হোঁচট খাওয়া, দারিদ্রের হীনমন্যতাকে দারুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সুদীপ্ত। কোনও কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকেন যাঁরা খুব ছোট পরিসরে কাজ করেও দর্শকদের নজর কেড়ে নেন। বলাকার ভূমিকায় নাসরিন তেমনই একটি কাজ করেছেন। অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং পরিমিত অভিনয় যা দেখে বোঝা যায় নাসরিন অনেক দূর যাবেন। তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। পরীর ভূমিকায় আম্রপালী মিত্র স্বতঃস্ফূর্ত। অন্যরাও মন্দ নন।
[ আরও পড়ুন: ‘জনতার টাকায় CAA করা আর সরকারি সম্পত্তি নষ্ট একই ব্যাপার’, কটাক্ষ পরমব্রতর ]
ডিরেকশনের কাজ নিয়ে দু’একটি কথা বলার আছে। মোহিত এবং সুরমাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে বোবা চাকর গণেশের আলো নেভানোর দৃশ্যটিতে যদি গণেশ নিঃশব্দে চলে যেতো তাহলে বোধহয় ভাল হত। এবং মনিব মোহিতকে চড় মারার দৃশ্যে গণেশার ক্রোধ আরও তীব্র হলে দৃশ্যটি আরও মধুর হতো। ক্রোধের সঙ্গে কান্নার একটু মিশেল থাকতেই পারত।
নাটকের শেষে মোহিতের পাগল হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি মনোগ্রাহী। তবে নাটকের প্রথমার্ধে এবং সারা নাটকজুড়ে মোহিতকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন অভিনেতা এবং নির্দেশক, সেক্ষেত্রে তাঁর এই পরিণতি কোথাও সামান্য হলেও যুক্তির দিক থেকে দুর্বল মনে হয়। এই বিষয়টি নির্দেশককে একটু ভেবে দেখতে অনুরোধ করলাম। নাটকটির আবহ ও মঞ্চসজ্জা যথাযথ। সব মিলিয়ে ‘সুরমা’ একটি উপভোগ্য পরিবেশনা।