Advertisement
Advertisement
Dadathakur

‘ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু…’ শতবর্ষ পরও ভোটবাজারে প্রাসঙ্গিক দাদাঠাকুর

'বোতল পুরাণে'র স্রষ্টাকে ভোলা যাবে না।

Vote songs written by Dadathakur Sarat Chandra Pandit are still contemporary
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:March 24, 2024 5:37 pm
  • Updated:March 24, 2024 7:13 pm

বিশ্বদীপ দে: বসন্ত এসে গিয়েছে। আর তার হাত ধরে এসে পড়েছে ভোট। যদিও তা শুরু হতে হতে গনগনে গরমের দিনগুলো পুরোদস্তুর শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে কাউন্ট ডাউন। কদিনের মধ্যেই ভোটপ্রচার চরম আকার ধারণ করবে। আর যত সময় যাবে, তত বেশি করে ফিরে ফিরে আসবেন এক অসামান্য বাঙালি পুরুষ। যাঁর পোশাকি নাম শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। কিন্তু তাঁকে আমরা আরও বেশি করে চিনি দাদাঠাকুর (Dadathakur) নামে। সেই কোন আদ্যিকালে তিনি লিখে গিয়েছিলেন ভোটের গান। আজও তা সমকালীন হয়ে রয়েছে। সেই জন্যই ‘বোতল পুরাণে’র স্রষ্টাকে আমাদের আরও বেশি করে দরকার পড়ছে।

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার দফরপুর নামের এক গ্রামে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই কবিত্ব ছিল তাঁর মজ্জায় মিশে। কথা নিয়ে খেলতে পারতেন অনায়াসে। তাঁর ‘Pun’ তো সর্বজনবিদিত। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে একবার বলেছিলেন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এই মানুষটিই দেশ থেকে ব্রিটিশদের তাড়াবেন। কারণ জানতে চাইলে বলেছিলেন, নেতাজির নামের আদ্যক্ষর ‘সু’ এবং নামের শেষ অর্থাৎ পদবি অন্তেও ‘সু’। এই জোড়া সু অর্থাৎ Shoe-র ঠোক্কর সামলাতে পারবেন না ইংরেজরা। এমন মানুষই যে ‘বিদূষকে’র মতো ব্যাঙ্গাত্মক পত্রিকা কিংবা ‘বোতল পুরাণে’র মতো মাতালদের নিয়ে বোতলের আকারে আশ্চর্য কবিতার পত্রিকা বের করবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। খোদ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মরি হায় রে/ কলকাতা কেবল ভুলে ভরা,/ সেথায় বুদ্ধিমানে করে চুরি/ বোকায় পড়ে ধরা’ শুনে মুগ্ধ হন। আর সেই তিনিই লিখেছিলেন ভোটের অনবদ্য গান বা ছড়াও। যা আজও মুখে মুখে ফেরে বহু মানুষের।

Advertisement

[আরও পড়ুন: বড় ভূমিকা ছিল রাফালে চুক্তিতে, এবার বিজেপিতে যোগ প্রাক্তন বায়ুসেনা প্রধানের]

দাদাঠাকুরের মতো মানুষরা আসলে চিরকালীন। মেধার এমন রসস্নিগ্ধ বিচ্ছুরণ কখনও ‘সেকেলে’ হয়ে যায় না। আজ থেকে একশো বছর আগে নেতামন্ত্রীদের ভোট-আকাঙ্ক্ষাকে হাসির চাবুকে রাঙা করে তুলে তিনি যা লিখে গিয়েছেন ভোটের বাজারে তার আবেদন একই রকম রয়েছে। অথচ যখন তিনি এসব লিখেছেন, তখন মোটেই প্রচারকৌশলের তেমন রমরমা কিছু ছিল না। তবে ভোটের গান বা ছড়ার প্রচলন ছিলই। দাদাঠাকুর এক বার জঙ্গিপুর মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে নিজের এক প্রার্থীকে দাঁড় করালেন। এর পিছনে একটা ‘গল্প’ রয়েছে। দাদাঠাকুরের পছন্দের সেই প্রার্থীর নাম কার্তিকচন্দ্র সাহা। তেলেভাজা-চানাচুরের ব্যবসা।

Advertisement

মিউনিসিপ্যালিটি তাঁর ট্যাক্স রাতারাতি দ্বিগুণ করে তিন আনা থেকে বাড়িয়ে করে দেয় ছআনা। চেয়ারম্যানের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হল না। তিনি চিঠির উত্তরই দেন না! শেষে দাদাঠাকুরের পরামর্শে কার্তিক দাঁড়িয়ে পড়লেন ভোটে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত হয়েছেন সেই সময়। ফলে তাঁর ওয়ার্ডে উপনির্বাচন। সেখানেই তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে। আর তাঁর জন্যই দাদাঠাকুর লিখলেন, ”মাছ কুটলে মুড়ো দেব, গাই বিয়োলে দুধ দেব,/ দুধ খাবার বাটি দেব, সুদ দিলে টাকা দেব,/ ঘি দিলে উকিল হব, চাল দিলে ভাত দিব।/ মিটিঙে যাব না, অবসর পাব না,/ কোন কাজে লাগব না/ যাদুর কপালে আমার ভোট দিয়ে যা।/ ভোট দিয়ে যা, আয় ভোটার আয়।” কী অব্যর্থ খোঁচা। বিরোধী প্রার্থীর বয়ানে নিজের ভোটের প্রচার। কেবল এটাই নয়, লিখেছিলেন এক জব্বর গান। কীর্তনের সুরে। লাইনগুলো এরকম- ‘আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু/ ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে/ (আমি ভিখারি, না শিকারি গো)/ মোরে ‘হাঁ’ ছাড়া কেউ ‘না’ বলিল না/ ক্যানভাস করিনু দ্বারে।’ বিরাট গান। যার আর এক জায়গায় রয়েছে ‘আমি নেতা কি অভিনেতা হেথা মালুম করিবে কে তা…’ ভোটে কার্তিকই জিতেছিলেন। বিপুল ভোটে।

[আরও পড়ুন: ভরা মেট্রোয় মাখামাখি দুই রঙিন তরুণীর! বিতর্কিত রিল নিয়ে মুখ খুলল কর্তৃপক্ষ]

আবার কলকাতা পুরসভার জন্য দাদাঠাকুর যে ছড়া লিখেছিলেন, তা কিন্তু মেজাজে একেবারে আলাদা- ‘যিনি তস্কর দলপতি দৈত্যগুরু/ যিনি বাক্যদানে আজি কল্পতরু/ ঠেলি নর্দমা কর্দমে অর্ধরাতে/ কত মর্দজনে ফিরে ফর্দ হাতে…’ কিংবা বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার উপনির্বাচনে লেখা ছড়া- ‘এবার হুইপ বেড়ে করবে হুইপ/ গ্যালপে চলেছি ভাই, করিব উইন রে/ দোহাই ভোটার যেন কোরো না রুইন রে।’ একই মানুষের কলমে কত ভিন্ন রসের কালি ভরা ছিল এথেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। আর প্রতিটি উচ্চারণই যেন রাজনীতির ময়দানের চিরকালীন ভাষ্য। তিনি বলতেন, ”এ মেলে, ও মেলে বলেই তো মশায়, আপনারা এমএলএ। আপনারা দেশের ‘নেতা’ অর্থাৎ ‘দেতা’ নেই।”

বহরমপুর মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রমণীমোহন সেন ও নীলমণি ভট্টাচার্য। ভোটের ফল ঘোষণার পরে দেখা গেল দাদাঠাকুরের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গিয়েছে। রমণী জিতেছেন। হেরেছেন নীলমণি। দাদাঠাকুর বললেন, ”সবই টাকার খেলা ভাই। Raw-money-র সঙ্গে Nil-money পারবে কেন?”

সময় বদলেছে। গত শতকের পাঁচ-ছয় দশক থেকে ধীরে ধীরে বদলেছে রাজনীতির ভাষা। যে স্নিগ্ধ রসবোধ ও অব্যর্থ টিপ্পনী মিশিয়ে দাদাঠাকুর তাঁর ভোটের গান বা ছড়া লিখেছেন, সেই সূক্ষ্মতা বহুদিনই অন্তর্নিহিত প্রায়। তবু ভোট এলে সুরসিক বাঙালির তাঁকে মনে পড়বেই। তিনি যা লিখেছিলেন, তা আজও রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে সত্য। সেই সত্য উচারণে দাদাঠাকুর যেমন কঠোর, তেমনই রসময়। এই স্নিগ্ধতা আজ একান্তই বিরল ও দুষ্প্রাপ্য। তাই শরৎচন্দ্রের কাছে আমাদের ফিরে আসতেই হয়। তাঁর ভোটের ছড়া-গানগুলোকে কখনও ‘সেকেলে’ বলে সরিয়ে রাখা যাবে না।

 

তথ্যঋণ: অদ্বিতীয় হাস্যরসিক দাদাঠাকুর/ শতদল গোস্বামী

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ