Advertisement
Advertisement
China

চিন না পাকিস্তান, প্রধান শত্রু কে? কী গল্প বলছে প্যাংগং-ডাল

পাকিস্তান, চিন- দুই দেশই ভারতের বৈভবে ঈর্ষান্বিত।

China or Pakistan, In search of the real threat | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 14, 2023 6:34 pm
  • Updated:June 14, 2023 6:34 pm

কারগিলের স্থানীয় এক টুরিস্ট কারের চালক হোটেলের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যর, এলওসি যাবেন?’ এমনভাবে কথাটি বললেন যেন সেটি কোনও টুরিস্ট স্পট। পৌঁছে দেখি কয়েকশো পর্যটক হাজির! ওপারে দখল হওয়া কাশ্মীরের অংশ দেখতে সে কী উদ্বেলতা! যেন খুব মজার বিষয়! কলমে কিংশুক প্রামাণিক

ভারতের প্রধান শত্রু কে? পাকিস্তান না চিন?
কঠিন এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করলাম প্রায় দশদিন লাদাখ ও কাশ্মীরের নানা প্রান্ত ঘুরে। এই এলাকা ভৌগোলিকভাবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই পর্যটনে গেলেও সাংবাদিকের নজর এড়াল না স্পর্শকাতর দিকটি। দেশের চূড়ার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে-তৎপরতা, তাতে মনে হল স্থল ও বিমান বাহিনীর ৭০-৮০ শতাংশ রসদ, সমরাস্ত্র মজুত এখানেই।

Advertisement

হিমাচলের দিক থেকে লাদাখের বড় অংশ, লেহ থেকে কারগিল হয়ে শ্রীনগর, কাছে-দূরে অথবা গায়ে গায়ে কোথাও চিন কোথাও পাকিস্তান সীমান্ত। প্রায় হাজার কিলোমিটার রাস্তায়
ছোট-বড় যত সেনা ছাউনি, বা সেনাদের গ্রাম, এয়ারবেস, হাসপাতাল, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়ের খাঁজে, চূড়ায়, উপত্যকায় দেখলাম, তার হিসাব রাখিনি। কোথাও বরফের ২০ ফুট দেওয়াল, কোথাও ১৮-২০ হাজার ফুটে বরফপাতের মধ্যে রাইফেল হাতে পাহারা। জল নেই, গাছ নেই, রুক্ষ প্রান্তর। অক্সিজেনের তীব্র অভাব। তবু অবিচল জওয়ানরা। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।

Advertisement

আরও বুঝলাম, পাকিস্তানের নাম শুনলে আমাদের ভিতর যত ক্রোধই জাগ্রত হোক না কেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিন-ই প্রধান মাথাব‌্যথা। তাদের আচরণ, গতিবিধি বড্ড গোলমেলে। হাতে অস্ত্রও অনেকে বেশি। সীমান্ত প্রস্তুতি অনেক আধুনিক। স্বভাবতই চিন সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে সেনাবাহিনীর যে ‘অ্যাটেনশন’ দেখলাম তা কম কাশ্মীরে। একদিকে যখন শ্রীনগরে রাত বারোটা পর্যন্ত কোলাহলমুখর ডাল লেকের পাড়, অন্যদিকে লাদাখের প্যাংগং লেকের দিকে চলেছে সারি সারি সাঁজোয়া গাড়ি। খুব কাছে দুরবুকে বিশাল সেনা ছাউনি। আয়োজন দেখে বুঝতে পারছিলাম আবার যদি গালওয়ানের মতো কোনও কাণ্ড চিন করে তাহলে এই দুরবুক হবে পালটা জবাবের বেস ক্যাম্প।

‘কারগিল’ নামটি শুনলেই বুকের মধ্যে কেমন যুদ্ধ-যুদ্ধ রব অনুভূত হয়। কখনও ভাবিনি কারগিলে একরাত হোটেলে নিশ্চিন্ত ঘুমব। পৌঁছনোর আগে বেশ উত্তেজনা অনুভূত হচ্ছিল। দেখে এলাম ‘এলওসি’ (লাইন অফ কন্ট্রোল)। স্থানীয় এক টুরিস্ট কারের চালক হোটেলের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যর, এলওসি যাবেন?’ এমনভাবে কথাটি বললেন যেন সেটি কোনও টুরিস্ট স্পট। পৌঁছে দেখি কয়েকশো পর্যটক হাজির! ওপারে দখল হওয়া কাশ্মীরের অংশ দেখতে সে কী উদ্বেলতা! যেন খুব মজার বিষয়! তৈরি হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার। ৫০ টাকার বিনিময়ে দূরবিন নিয়ে ওপারে মসজিদ, গ্রাম দেখাচ্ছিলেন স্থানীয় এক যুবক। তাঁর সামনে রীতিমতো লাইন পড়ে গেল। ‘আমি দেখেছি’, ‘আমি দেখেছি’ বলে সে কী উন্মাদনা!

এখানে সেনার দেখা পেলাম না। সন্দেহের চাউনিও নেই। মনে হল না স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ওদিকেও কেউ সীমানা পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু প্যাংগংয়ে একটা পয়েন্টের পর আমাদের আটকে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়, লেকের মাঝে ‘এলএসি’ (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) আছে। আর এগনো যাবে না। ১৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল জলের হ্রদ প্যাংগং। এর তিন ভাগের এক ভাগ ভারতে। বাকি দু’-ভাগ চিন দখল করে রেখেছে। তাই ২০-২৫ কিলোমিটার আগে থেকেই আমাদের আর যেতে দিলেন না সেনা জওয়ানরা।

এই কারগিলকে দেখলে মনেই হবে না চব্বিশ বছর আগে ৫০০ জওয়ানের রক্তে স্নাত হয়েছিল বরফের পাহাড়গুলি। প্রায় তিন মাসের সেই যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল, আর ভারতীয়দের মধ্যে ইসলামাবাদ সম্পর্কে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠেছিল। তাই রণে-বনে, জলে-জঙ্গলে, ক্রিকেট মাঠে বা হকির অ্যাস্ট্রোটার্ফে যেখানেই দেখা হোক, পাকিস্তানকে হারানোটাই দস্তুর। দ্রাসে ওয়ার মেমোরিয়াল দেখে ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। তথ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে কীভাবে ১৯৯৯ সালের পাক সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফের প্ল্যানে গোটা এলওসি জুড়ে সেনা ও জঙ্গিদের সাজিয়ে কাশ্মীর নিজেদের কবজায় আনার চেষ্টা করেছিল ইসলামাবাদ। অমিতাভ বচ্চনের ভয়েসওভার দুর্দান্ত। পাশেই উঁকি দিচ্ছে টাইগার হিল। শ্বেতশুভ্র বরফচূড়া সোনা রোদ মেখে হাসছে। ওই পাহাড় থেকে হানাদারদের সরিয়ে ‘অপারেশন বিজয়’ সফল হওয়ার ঘোষণা করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী।

চিন ও পাকিস্তান দুই দেশের সঙ্গে ভারতের একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের রক্তে পাকিস্তান বিরোধিতা। একজন ভারতীয় জন্ম থেকে জেনে এসেছে, পাকিস্তান দেশের শক্র। এর কারণ দেশভাগ। ধর্মের মোড়কে পাকিস্তানের জন্ম। ফলে ধর্ম হয়েছে রাজনীতির খোরাক। ওরা মুসলিম আমরা হিন্দু, এই বিদ্বেষকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভোটের অঙ্কে। সেই আবেগ কতটা পাওয়ারফুল সে তো আমরা সাড়ে চার বছর আগে পুলওয়ামা বিস্ফোরণ ও তার পরবর্তী বালাকোট কাণ্ডের পর দেখলাম। সহানুভূতির মহাস্রোতে বিরোধীদের ভাসিয়ে নিশ্চিত পরাজয় রুখে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি।

রাজনীতির কথা থাক। উপত্যকার ‘মন কি বাত’ আসলে কী? কোথায় গেল জঙ্গিরা? কেন পর্যটনে লক্ষ্মীলাভের আশায় স্থানীয় যুবকরা?

অঙ্কটা খুব সহজ। পাকিস্তান যত দুর্বল হচ্ছে, তত কাশ্মীর শান্ত হচ্ছে। লাগাতার জঙ্গিবাদকে মদত দেওয়া, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে সেনার কর্তৃত্ব কায়েম, অর্থনীতির দুর্দশা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার গ্রাসে পাকিস্তান। ভারতের সঙ্গে শত্রুতার সময় তাদের নেই। ফলে সীমান্তে জঙ্গিরাও মদত পাচ্ছে না। তাই শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ, জোজি লা পাস থেকে কারগিল, সর্বত্র জনজীবন শান্ত। পর্যটনে জোয়ার। একবছর আগেই ডাল লেকের পাড়ে উর্দিধারীদের শশব্যস্ততায় ভয় লাগছিল। এবার উলটো চিত্র।

ভারতের শীর্ষে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য। বিভাজনের পর জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ, তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়েছে। কিন্তু মানচিত্রে যে-কাশ্মীর দেখানো হয় তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। বেশিরভাগ অংশ দখল করে রেখেছে পাকিস্তান- যাকে ‘আজাদ কাশ্মীর’ বলা হয়। পূর্বে লাদাখেরও একটি বড় অংশ দখল করে রেখেছে চিন- যাকে বলা হয় ‘আকসাই চিন’। শুধু লেহ থেকে উত্তরে সিয়াচেন হিমবাহ বরাবর অংশ ভারতের। যেখানে রয়েছে আফগানিস্তান সীমান্তও। স্বভাবতই সিয়াচেনই কার্যক্ষেত্রে ভারতের শীর্ষ অংশ। এবং অবশ্যই স্ট্র্যাটেজিক জোন। লেহ থেকে দূরত্ব ১৮০ কিলোমিটার। পেরতে হবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পাস খারদুং লা প্রায় ১৮ হাজার ফুট। এখানে মাইনাস টেম্পারেচারে বরফের উপর দেশ পাহারা দেন বীর জওয়ানরা।

[আরও পড়ুন: ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু, এটাই কি ব্রিটেনের রাজার শেষ রাজ্যাভিষেক?]

প্রধান শক্র কে তা চিনে নিতে একবার সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস বসেছিল। শেষ অবধি ‘বুর্জোয়া’ কংগ্রেসকে ক্লিনচিট দিয়ে ‘ফ্যাসিস্ট’ বিজেপিকে প্রধান শক্র ঘোষণা করেছিল কমিউনিস্টরা। আবার প্রধান শত্রুর পরিবর্তনও হয়ছিল। রাজীব গান্ধী যখন প্রধান শক্র ছিলেন তখন শহিদ মিনারে জ্যোতি বসুর সভায় ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।

রাজনীতিতে এমন হয়। কূটনীতি অন্য বিষয়। বাস্তবে মনে হয়, উপর থেকে যত দুর্বল দেখাক, এই পাকিস্তানকে বিশ্বাস করা যায় না। তাদেরও রক্তে-ধর্মে-রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। কাশ্মীরের সবুজ প্রকৃতির মতোই ধু ধু মরুপ্রান্তর, গাছপালাহীন রুক্ষ লাদাখি প্রকৃতির একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। তাই প্রধান শত্রুর পরিবর্তন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকবে। ডাল হোক বা প্যাংগং, কোনও লেকের পাড়ে সেনাদের গাছাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। পাকিস্তান, চিন- দুই দেশই ভারতের বৈভবে ঈর্ষান্বিত। কারগিল যুদ্ধ থেকে গালওয়ান আগ্রাসন, সেটাই প্রমাণ করে। তাই উভয়ই ‘প্রধান শত্রু’।

[আরও পড়ুন: সেকেন্ডে ৪ লক্ষ টাকা ঋণ! মোদিরাজে কি বিকিয়ে যাবে ঢাক-মনসা দুই-ই?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ