ইন্দ্রনীল শুক্লা: উদ্বাস্তু সমস্যা! বিশ্বে এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় সমস্যা বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হয় না। বিশ্বের নানা দেশের সীমানা নিয়ে অসন্তোষ, দেশের বিভাজন, ভূখণ্ড অধিগ্রহণ, বিবিধ কারণের মনান্তরে যুদ্ধ চলতেই থাকে। আর প্রতিবারেই নিজেদের সাজানো ঘর-সংসার থেকে উৎখাত হতে হয় বিপুল সংখ্যার সাধারণ মানুষকে, যারা নিতান্তই নিরীহ ও নিরপরাধ, যাদের এই যুদ্ধে কিংবা সন্ত্রাসে কোনও ভূমিকা নেই। অতি সাধারণ মানুষ যারা, তারাই প্রতিবার কিছু খামখেয়ালি যুদ্ধ ও ভয়াবহ সন্ত্রাসের শিকার। পরিচয়পত্র, নাগরিকত্ব ইত্যাদি নিয়ে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ঘুম হারাতে হয় মানুষকে। এই যে বিপুল এক সমস্যা একেই ধরার চেষ্টা করেছে স্যাফায়ার ক্রিয়েশনস ডান্স কোম্পানি। কলকাতার তথা ভারতের প্রথম সারির এই ক্রিয়েটিভ ডান্স সংস্থা আগেও বহু বিষয় নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রোডাকশন তৈরি করেছে। ‘কিতারেবা’ তাদের সাম্প্রতিক উপস্থাপনা। এইসিলেটি কথার অর্থ ‘আছো কেমন’!
সুদর্শন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে এই নতুন প্রোডাকশনটিতে ক্রিয়েটিভ ডান্স তো রয়েইছে, সেই সঙ্গে উপস্থাপনার তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে অভিনয়। অবশ্য, নৃত্যের তাত্ত্বিক মানুষ বলতেই পারেন, অভিনয় তো নৃত্যেরই অংশ। এই যুক্তিও সত্যি।
কেমন সে ড্রামাটিক প্রয়োগ? একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ঘনান্ধকার প্রেক্ষাগৃহের ভিতরে হঠাৎ করেই বেশ কয়েক জনের হাতে জ্বলে উঠল তীব্র টর্চের আলো। আলোর বিচ্ছুরণ রীতিমতো যন্ত্রণা দিল দর্শকের চোখকে। আর তারপরই সমস্বরে সেই টর্চধারীরা বলতে শুরু করল, ‘নাম কী তোমার? কাগজ কোথায়? কাগজ দেখাও!’ তারপর হঠাৎ করেই কাগজ দেখাতে না পারা এক যুবককে কলার ধরে তুলে নেওয়া হল মঞ্চে। কাগজ খোঁজার অছিলায় তাকে প্রায় নগ্ন করে চলতে থাকল ‘সার্চ’। নাগরিকত্ব কিংবা পরিচয়পত্রের ভীতিটা একটা ছোট্ট মুহূর্তের জন্য হলেও স্নায়ুর ভিতর দিয়ে বয়ে যেতে বাধ্য।
এই যে পরিচয়ের ভয়, ঘর হারানোর ভয়, বন্দি হওয়ার ভয়, অত্যাচারের ভয়, ধর্ষণের ভয়- এসবই বয়ে গিয়েছে ‘কিতারেবা’ জুড়ে। আর ঠিকড়ে পড়েছে তীব্র হতাশা। সব কিছু হারিয়ে পথের ধারে, ফুটপাথে, রেলস্টেশনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হওয়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার। সে হাহাকারে ইহুদি শিশুর সঙ্গে হিরোশিমা-নাগাসাকির শিশুতে তফাত থাকে না। বাংলা-পাঞ্জাব বিভাজনে ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে রোহিঙ্গার তফাত থাকে না। ব্যতিক্রম নয় আজকের ইউক্রেনীয় কিংবা গাজা ভূখন্ডের শিশু ও নারীরাও। সমরাঙ্গনের সমান্তরালেই আরও বড় একটা চক্র চলতেই থাকে পাচারের, শোষণের, দাসত্বের। মাথার উপর একটা ছাদ, থালায় একটু খাবার, ইস্কুলের শিক্ষাটুকু পেতে অসহায় মানুষকে কত কিছুই সয়ে নিতে হয়। মনে পড়ে যায়, কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘এস দেখে যাও’ কবিতার প্রথম স্তবক, ‘এস দেখে যাও কুটি কুটি সংসার/ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছড়ানো বে-আব্রু সংসারে/ স্বামী নেই, গেল কোথায় তলিয়ে/ ভেসে এসে আজ ঠেকেছে কোথায় ও-যে/ ছেঁড়া কানিটুকু কোমরজড়ানো আদুরি, ঘরের বউ/ আমার বাংলা।’ ‘কিতারেবা’-য় নাচে, গানে গোটা গ্রুপের সার্বিক আদান-প্রদানটা চোখে পড়ে। প্রোডাকশন জুড়ে অসাধারণ আলোর ডিজাইনে জাদু-বাস্তবতা গড়ে দিয়েছেন দীনেশ পোদ্দার। আর একদম শেষ অংশটায় সুদর্শন চক্রবর্তী এমন একটু সুর বেঁধে দিয়েছেন যে চোখে জল এসে যায়। শুধু পরিচয়পত্র দেখাতে পারেনি বলে কোনও বন্ধুকে, কোনও সুহৃদকে একদিন বিদায় জানাতে হবে নাতো! বুকটা কেঁপে যায় হঠাৎ!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.