Advertisement
Advertisement
Salman Rushdie

জল্পনা সত্ত্বেও এবারও নোবেল পেলেন না ভারত-জাত সলমন রুশদি

এবারের নোবেল গেল নরওয়ের জন ফসের ঝুলিতে।

Salman Rushdie not get the Nobel this time too। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:October 6, 2023 7:36 pm
  • Updated:October 6, 2023 7:36 pm

২০২২ সালে মনোনীত হয়েছিলেন নোবেল সম্মানের জন্য। এমনকী, এবছরও। কিন্তু ভারত-জাত সলমন রুশদি পেলেন না। নোবেল গেল নরওয়ের জন ফসের ঝুলিতে। রবীন্দ্রনাথের পর ১১০ বছরে সাহিত্যে আর কোনও নোবেলজয়ী নেই ভারতে! লিখলেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ‌্যায়

১৯১৩ সাল। শান্তিনিকেতনে পূর্ণিমার সন্ধে। বনের মধ্যে শান্তিনিকেতনের আশ্রমের ছাত্রদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চন্দ্রালোকিত চড়ুইভাতি। গরুর গাড়িতে রবীন্দ্রনাথ চলেছেন চড়ুইভাতির পথে। তাঁর কাছে এল এই অপ্রত‌্যাশিত তার-বার্তা। ‘গীতাঞ্জলি’-র জন‌্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সেই ঘটনার পরে কেটে গিয়েছে ১১০ বছর। আর কোনও ভারতীয় সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পাননি।

Advertisement

এই বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন ভারতে জন্মানো আরও একজন সাহিত্যিক! ১৯৪৭ সালে, রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের ছয় বছর পর, তাঁর জন্ম হয় বোম্বে (এখন মুম্বই) শহরে। শিরায় বইছে ভারতীয় রক্ত, যদিও পরিচয়ে তিনি ‘ব্রিটিশ-আমেরিকান’। তাঁর প্রথম উপন‌্যাস ‘মিডনাইট্‌’স চিলড্রেন’ (১৯৮১), যা তাঁকে পৌঁছে দেয় চূড়ান্ত আন্তর্জাতিক খ‌্যাতি এবং ‘বুকার প্রাইজ’ (১৯৮১) পুরস্কারে, আর সেই উপন‌্যাসের বিষয় কিনা সবে স্বাধীন হওয়া আধুনিক ভারত। কী এসে যায় রুশদির ভাষা যদিও ইংরেজি! ইংরেজি তো ভারতের বহু ভাষার একটি। ভুললে হবে না, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান তাঁর ইংরেজি গীতাঞ্জলি ‘সং অফারিংসে’র জন‌্য, যার ভাষা ইংরেজি গদ‌্য!

Advertisement

[আরও পড়ুন: দত্তপুকুরে ফের বিস্ফোরণ, বল ভেবে খেলতে গিয়ে জখম ৫ কিশোর] 

নির্বাচিত হয়েও শেষ পর্যন্ত রুশদির কাছে এ-বছর অধরাই রয়ে গেল সাহিত্যের এই মহা স্মারক। ২০২৩ সালের নোবেল পুরস্কার ধাবিত হল নরওয়ের গদ্যশিল্পী, নাট্যকার ও কবি জন ফসে-র ঝুলিতে। যাঁর স্বীকৃতি সম্বন্ধে নোবেল কমিটি বলেছে, ‘ফর হিজ ইনোভেটিভ প্লেস অ্যান্ড প্রোজেস হুইচ গিভ ভয়েস টু দ্য আনসেয়েবল।’ তবে এর পরও এই লেখা জন ফসেকে নিয়ে নয়, বরং রুশদিকে নিয়েই, বারবার নমিনেটেড ও শর্ট লিস্টেড হয়েও যিনি থেকে যাচ্ছেন– অন্তত নোবেল প্রাপ্তির নিরিখে– নিষ্ফল ও হতাশের দলে।

সলমন রুশদির সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় এমন একটি উপন‌্যাসের মাধ‌্যমে, যার ভাষা ইংরেজি হলেও ‘বিষয়’ ভারতের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দারিদ্র‌, রিকশাওয়ালার মতো সাধারণ মানুষের যাপন, যন্ত্রণা, বিশ্বাস, লড়াই। রুশদি কী অনায়াস সাবলীলতায় সেই যন্ত্রণা, প্রত‌্যয় ও প্রাত‌্যহিক যুদ্ধের সঙ্গে বুনে দিয়েছেন ভারতের সাধারণ মানুষের চেতনা এবং তাদের নিরন্তর দৈনন্দিনের গল্প; যে-গল্প পায়ে-পায়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভারতকে, যে-গল্প নিভে যাবে না কোনও দিন। ভারত, ভারতের ঐতিহ‌্য, ভারতের প্রাচীন সাহিত্য, ভারতের বাস্তব ও স্বপ্ন, ভারতের সমাজ, পরিবেশ, মানুষ ফিরে-ফিরে এসেছে রুশদির লেখায়। কোনও দিন তিনি ছিন্ন হয়ে যাননি ভারত থেকে। তঁার শেষ প্রেমিকা ও স্ত্রী, পদ্মলক্ষ্মী, ভারতেরই মেয়ে!

[আরও পড়ুন: হাই কোর্টের রায় শুনেই জ্ঞান হারালেন কামদুনির প্রতিবাদী মুখ মৌসুমী, হতাশ টুম্পাও]

আরও একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাহিতি‌্যক, ত্রিনিদাদের মানুষ, ভি. এস. নয়পল– তিনিও সাহিতে‌্যর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতে এসেওছেন একাধিকবার, হারানো শিকড়ের সন্ধ‌ানে। কিন্তু আজীবন থেকেছেন সর্বতোভাবে ভারতবিদ্বেষী। ভারত বিষয়ে তঁার দু’টি বই– অসামান‌্য ইংরেজি গদে‌্য লেখা– ‘অ‌্যান এরিয়া অফ ডার্কনেস’ এবং ‘অ‌্যান উন্ডেড সিভিলাইজেশন’– তঁার ভারত-বিদ্বেষের নির্ভুল সাক্ষ‌্য বহন করছে।

ভি. এস. নয়পলের সঙ্গে এখানেই মূল পার্থক‌্য সলমন রুশদির। দু’জনেরই শিকড় ভারতে। নয়পল ভারতকে ভালবাসতে পারেননি। রুশদি পেরেছেন। বরং কখনও ছিঁড়তে পারেননি সেই ভালবাসার বন্ধন, সেই মেদুরতার টান। নয়পল এবং রুশদির মধে‌্য আরও একটি প্রভেদের কথা বলতেই হবে। ভি. এস. নয়পলের অসামান‌্য সহজ গদে‌্যর শৌভিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করে আমাদের, বুঝতে পারি, কেন তিনি এ-যুগের শ্রেষ্ঠ ইংরেজি গদ‌্যকারদের অন‌্যতম, এমনকী, যখন তিনি ভারত-বিরোধী কথা বলছেন, তখনও! আর, পুরোপুরি বিপ্রতীপ গদ‌্য লেখেন সলমন রুশদি। রুশদি শুধু পণ্ডিত নন। প্রজ্ঞাবান। এবং তঁার উপন‌্যাসের ভাষাও যত দিন যাচ্ছে হয়ে উঠছে বহুপরতাশ্রয়ী জটিল। সহজ নয় সেই গদে‌্যর জটিলতা পেরিয়ে তার মর্মার্থে পৌঁছনো। তঁার গদ‌্য পড়ার সঙ্গে পেঁয়াজ ছাড়ানোর অভিজ্ঞতার তুলনা চলে হয়তো।

কারণ, সহ‌্য করতে হয় শব্দের ঝঁাজ। ফেলতে হয়, একটির-পর-একটি পরত ছাড়াতে ছাড়াতে, চোখের জল। তবু মনে তো হয়, সলমন রুশদি পড়া মানে ধ্রুপদী সাহিতে‌্যর অঁাচ পোহানো। তঁার লেখা যে বই-ই পড়ি না কেন– ‘শালিমার দ‌্য ক্লাউন’, ‘লুকা অ‌্যান্ড দ‌্য ফায়ার অফ লাইফ’, ‘দ‌্য গোল্ডেন হাউস’, ‘দ‌্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট’, ‘শেম’ কিংবা ‘টু ইয়ার্স এইট মান্থস্‌ অ‌্যান্ড টোয়েন্টি এইট নাইটস’– সবসময় মনে হয়, ধ্রুপদী সাহিতে‌্যর ফায়ার প্লেসের পাশে তাপ পোহাচ্ছি। উড়ছে শব্দের স্ফুলিঙ্গ। বহ্নিমান ভাষা আমাদের দগ্ধ করছে। এবং দহন ভাল লাগছে।

একটা কথা, তঁার লেখা ছোটদের গল্প– ‘হারুন অ‌্যান্ড দ‌্য সি অফ স্টোরিজ’-এ কি নিরন্তর ঢেউ তুলছে না রূপকথার ভারত? কিন্তু ছোটদের গল্পেও রুশদি সরে যাননি তঁার আড়ালের লেখা, তঁার তির্যক গভীরতা, তঁার প্রজ্ঞার ব্ল‌্যাকহোল থেকে, যা শুষে নেয় আমাদের। পালানোর পথ নেই বড়দেরও! এবং এমনকী ছোটদের গল্পেও এমন কথা অতর্কিতে উচ্চারণে আনেন তিনি, যা তুলতে পারে বিতর্ক, কিংবা চায়ের পেয়ালায় তুফান! নয়পল-ও বিতর্কিত লেখক। যে-লেখককে নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই, তিনি কি লেখক? এ-প্রশ্ন তো প্লেটোর কাল থেকেই জীবন্ত। তবু তফাতও আছে নয়পল এবং রুশদির বিতর্কিত হওয়ার মধে‌্য। রুশদিকে হতে হয়েছে এমন বিতর্কের শিকার, যে-বিতর্ক তঁাকে বারবার বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে জীবন থেকে। কিন্তু শেষ শ্লেষ এখানে– তঁাকে নিয়ে সব বিতর্ক ক্রমাগত তঁাকে দিয়েছে অমরত্ব। ছুরি দিয়ে তঁার চোখ উপড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে! কিন্তু তঁার লেখা আমাদের করেছে নতুন দৃষ্টিদান।

এই বছরে প্রকাশিত, এখনও পর্যন্ত শেষ উপন‌্যাস, রুশদির ‘ভিকট্রি সিটি’ যঁারা পড়েছেন, তঁারা অন্তত জানেন, এই মাস্টারপিসের বিষয় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে সুপ্রাচীন ভারতের দাক্ষিণাতে‌্য– দক্ষিণ ভারতের দেবদেবী, সংস্কার, বিশ্বাস, যৌনতা ও প্রজ্ঞার প্রাঙ্গনই এই উপন‌্যাসের সঞ্চারভূমি। রুশদির শেষ স্ত্রী পদ্মলক্ষ্মী দক্ষিণ ভারতেরই এক পরমা। এবং এই উপন‌্যাসের নারী-চরিত্রগুলির সেক্সুয়ালিটির সঙ্গে কি মিশে যায়নি পদ্মলক্ষ্মীর অবিকল্প আকর্ষণ? আমরা কি ভুলতে পারি এই উপন‌্যাসের দক্ষিণী পণ্ডিত বিদ‌্যাসাগরকে, যঁার সংস্কৃত প্রজ্ঞার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রবল নারী-লিপ্সাও! এই উপন‌্যাসেই এক চোখ-হারানো রুশদি দেখিয়ে দিয়েছেন তঁার লেখা আমাদের নব-দৃষ্টিদানের স্বার্থে কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে! এই উপন‌্যাসেই তিনি তুলেছেন এই অভিনব, পৃথিবী-কঁাপানো প্রশ্ন– কোনও সভ‌্যতা কি সতি‌্যই গড়ে উঠতে পারে কোনও ম‌্যাজিক বীজ থেকে, যে-বীজ জন্ম দিতে পারে আর-এক অলৌকিক সভ‌্যতার, কিন্তু যে-বীজ ধারণ করে না কোনও নিরন্তর, বিস্তৃত সাংস্কৃতিক স্মৃতি? এই প্রশ্নের ‘দৃষ্টিদান’ কি পৌঁছে দেয় না অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে?

বারবার মনোনয়ন পেয়েও নোবেল পাননি রুশদির সমকালের আরও একজন বিশিষ্ট লেখক মিলান কুন্দেরা। এহেন কুন্দেরা-ই লিখেছিলেন– ‘The struggle of man against power is the struggle of memory against forgetting.’ ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই রুশদি লড়ে আসছেন ‘দ্য সেটানিক ভার্সেস’ (১৯৮৮) প্রকাশের পর থেকেই। এই সংঘাত ও সংঘর্ষের প্রতর্কটি বিস্মৃতির বিরুদ্ধে, আত্ম-অস্তিত্বের মুছে না যাওয়ার বিরুদ্ধেও। সমাজের মুরব্বিরা তঁার মুণ্ড দাবি করেছিল। ফতোয়া জারি হয়েছিল তঁার নামে। কিন্তু এতে দমে যাননি বা লেখা থামাননি রুশদি। স্বীকৃতি-স্বরূপ পেয়েছেন ‘বুকার অফ দ্য বুকারস’ (১৯৯৩)। সেদিক থেকে দেখলে– সাহিত্যের সংসারে রুশদি ইতিমধ্যেই স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। নোবেল পুরস্কার সেই স্থায়িত্বের সিংহাসনে একটি ঝলমলে মুক্তো হয়ে টিপের মতো আটকে যেতে পারত। দুর্ভাগ্য, এ-বছর হল না তা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ